লিখেছেন । আশিকউজ্জামান টুলু
ব্যান্ড নিয়ে ঢাকার বাইরে প্রোগ্রাম করতে যাওয়ার একটা পৈশাচিক আনন্দ আছে। অবারিত গা জ্বালানো আনন্দ। একে তো অর্গানাইজারদের কাছে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট, তার ওপর আবার জার্নির আনন্দ, নতুন জায়গায় ভ্রমণ, নতুন লোকের সাথে পরিচয়, স্থানীয় সুন্দর জায়গাগুলোতে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো, হঠাৎ রাস্তায় থেমে টং দোকানে চা খাওয়া, পাশে বসে থাকা একেবারে অপরিচিত খুব সাধারণ লুঙ্গি পরা লোকের দিকে তাকিয়ে দেখা বা কথা বলা– যার মোটেই কোনো হাই অ্যাম্বিশন নাই আমাদের মতো, যার শুধু তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা হলেই জীবন সুন্দর, অথবা রিকশাওয়ালা– যে কোনোদিন ঢাকাতে আসেনি এবং প্রয়োজনও বোধ করে না ঢাকাতে আসার, বিকেল হলে ফিরে যায় ওর ছোট্ট নীড়ে যেখানে হয়তো কারেন্টের বাতি নাই, আছে শুধু একটা কুপি অথবা হারিকেন, যার সবচাইতে বড় স্বপ্ন হয়তো একটা টেলিভিশন কেনা। এই টেলিভিশনটা কেনা হয়ে গেলেই যার সংসারে হয়তো সুখের বন্যা বইবে। এই বিষয়গুলো ভীষণভাবে মনকে নাড়া দেয়।
আরও আছে, প্রোগ্রাম যখন সাকসেসফুল হতে থাকে, দর্শকদের এক্সপ্রেশন, ভালোবাসা, পাগলামি, গান চলাকালীন হটাৎ স্টেজে ঠিক পাশে এসে অনেক ভালোবাসা নিয়ে যখন অর্গানাইজারদের একজন বলে– ‘ভাই, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? কিছু লাগবে?’– এই দুই লাইনের ছোট্ট কথাটা শুনতে এত্তো ভালোলাগে, কী বলব! এ-ই আমাদের শিল্পীদের পাওয়া, এই পাওয়াটার জন্যই খেটে যাওয়া দিবারাত্রি। তারপর যখন পেমেন্টটা পাই, তখন মনে পড়ে যায় কিশোর কুমারের একটা গান– ‘মনে হয় স্বর্গে আছি।’ পেমেন্টটা আসলে ঈদের বোনাসের মতো, এক্সট্রা পাওয়া।
***
ব্যান্ডের সবাই একসাথে এই জার্নির আরেক ধরনের আনন্দ আছে। একবার ঢাকার বাইরে প্রোগ্রামে যেয়ে অনুষ্ঠানের পর পেমেন্টটা পেয়ে আমাদের ড্রামার যে ক্লাস সেভেনে পড়ত, তখন বলে উঠল, ‘কালকে গার্লফ্রেন্ডকে একটা ডায়মন্ডের আংটি প্রেজেন্ট করব।’

আমি জানতাম না যে পাঁচ হাজার টাকাতেও ডায়মন্ডের আংটি পাওয়া যায়। আমার ধারণা ছিল, ডায়মন্ড মানে লাখ লাখ টাকার ব্যাপার। ও বলল, বায়তুল মোকাররমে মোনা জুয়েলার্সে ৫০০০ টাকায় ডায়মন্ডের আংটি পাওয়া যাবে।
ওর কথা শুনে আরেক ব্যান্ড মেম্বার বলল: ‘ওররে বাপরে, তোর আবার গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি? এখনো নাক টিপলে দুধ বাইরায়!’
ও বলে উঠল: ‘কেন? ক্লাস সেভেনগো মনে কি প্রেম থাকে না? এত বড় বড় প্রোগ্রাম চালায়া নিতাসি, একটা গার্লফ্রেন্ড চালাইতে পারুম না?’
…
‘তোর
লজ্জা লাগে
না তোর বাপের
বয়সী আমাগো সামনে
গার্লফ্রেন্ডের কথা
বুক ফুলায়া
কস?’
…
আমি বললাম: ‘শোন, তোর মুখে কিন্তু গার্লফ্রেন্ড কথাটা মানায় না! তোর তো খেলনা গাড়ি দিয়া খেলার বয়স এখনো যায় নাই। তুই নৌকা নিয়া ঘুরলে হইব? তোর বাপে দেখলে তো চুমুক দিয়া কলিজা খায়া ফালাইব! তোর লজ্জা লাগে না তোর বাপের বয়সী আমাগো সামনে গার্লফ্রেন্ডের কথা বুক ফুলায়া কস? তুই এখনো হাফ-প্যান্ট পরস, কেমনে প্রেম করলি? কে তোরে মন দিলো? ঠিক বুঝলাম না, ঐ মেয়ের কি তার ছিড়া? তুই কি বুঝস ডেটিং করার সময় কী কইতে হয়?’
ও বলল: ‘আমার সাইজ দেইখা কেমনে তুমি ভাইবা নিলা আমি প্রেম করতে পারুম না? জানো, কাইলকা আমাগো প্রেমের দুই বছর অ্যাফেয়ার অ্যানেভারসারি?’
আমি বললাম: ‘কাইল তোগো অ্যাফেয়ার ইউনিভার্সিটি?’
ও বলল: ‘ইউনিভার্সিটি না, অ্যানেভারসারি।’
আমি বললাম: ‘ওই একই কথা। তো, তাইলে কি তুই ক্লাস ফাইভ থেইকা শুরু করসোস প্রেম?! এই জন্যই তো কই পড়াশুনার এত মাজুল অবস্থা কেন! ইংরেজি ট্রান্সলেশন কর তো– ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেলো।’
ও বলল: ‘তুমি বিশ্বাস করো না, আমি কাইল তোমার বাসায় নিয়া আসুম।’
***
ঠিকই পরের দিন ও প্রেমিকাকে নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিল আমার বাসায়। আসলে এত কম বয়সে হাতে এই পরিমাণ টাকা এলে মাথা ঠিক থাকে না। ওই ড্রামার ঠিকই খুব কম বয়সে বিয়েটাও সেরে ফেলেছিল। আমরা তো আকাশ থেকে পড়েছিলাম শুনে।
যাইহোক, আবার পুরোনো কথায় ফিরে আশা যাক। একবার গেলাম কুমিল্লায় প্রোগ্রাম করতে। সাউন্ড সিস্টেম হিসাবে নিয়েছি কলরেডী থেকে দুটো স্পিকার। ওগুলো লোকাল, হাতে বানানো স্পিকার; অর্থাৎ ইন্ডিয়ান দুইটা ১২” উফারের সাথে টুইটার একটা বড় কাঠের বাক্সের মধ্যে লাগিয়ে স্পিকার বানানো। দেখতে বেশ বড়; তবে সাউন্ড খুব মাজুল। অর্থাৎ, ভালো না। তবু মাইকের হর্নের চাইতে বেটার। তখনো মার্কটে পিভির SP2 বা SP4 আসেনি। মাইক অথবা হাতে বানানো ওই স্পিকারই একমাত্র ভরসা। লাকী (আখান্দ) ভাইয়ের কাছ থেকে একটা বেজ এমপ্লিফায়ার ভাড়া নিয়েছি। আরেক জায়গা থেকে কিবোর্ড ও লিড এমপ্লিফায়ার, বেজ গিটার ও কিবোর্ড ভাড়া নিয়েছি।
লাকি ভাইকে বলি নাই যে আমরা ঢাকার বাইরে নিয়ে যাব; কারণ বললে লাকি ভাই দিবেন না।

কুমিল্লার টাউন হলে প্রোগ্রাম। যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম। অর্গানাইজার দৌড়ে এলো একবুক উষ্ণতা নিয়ে। সবকিছু ধরে ধরে নামাতে থাকল; পারলে আমাদেরও কোলে করে নামিয়ে দেয় আরকি! আবেগের বন্যায় সবাই ভেসে যাচ্ছে। আমরাও বেশ একটা দিগ্বিজয়ের ভাব নিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকলাম।
আমাদের এক ব্যান্ড মেম্বার আবার দর্শক শ্রোতা দেখলেই গম্ভীর হয়ে যেত; গলা বেজে নেমে যেত। কথা কম বলত। বললেও উচ্চারণটা কিছুটা ইংরেজি ঢঙে করত। ভাবখানা এমন যে, বাংলা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আমরা ওকে নিয়ে খুব হাসতাম। আমি বলতাম ওকে, ‘শালা ইংরেজি ২ বার পরীক্ষা দিয়া তবে পাশ করোস, অথচ পাবলিক দেখলেই বাংলা কইতে পারস না! গম্ভীর হইয়া যাস!’
আসলে এগুলি কিছুই না; এগুলি হলো ‘ইমেজ’। এই ইমেজেই শেষ করে ফেলে অনেক কিছু।
***
সময়মতো অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। ওই একজোড়া মাজুল স্পিকার দিয়েই দিগ্বিজয় শুরু করে দিলাম আমরা। জীবনে একটা জিনিস বুঝেছি; আর তা হলো, গানের সুর প্রথমে এবং তারপর কথা– এই দুইটা যখন ভালো হয় এবং মানুষের মনকে দোলা দেয়, তখন আর কিচ্ছু লাগে না গান হিট করার জন্য; খুব সাধারণ গলায় গাইলেও গান হিট হয়ে যায়।
আর সুর এবং কথা যদি ভালো না হয়, যতই দুর্ধর্ষ মিউজিক অ্যারেন্জমেন্ট আর অটো টিউন দিয়ে গলা টিপে ধরা হোক না কেন, কোনো লাভ নাই রাজেশ; গান মাটিতে গড়াগড়ি খাবেই।
***
একটা অতি উৎসাহী ছেলেকে দেখলাম দুই মিনিট পর পর এসে খবর নিচ্ছে। প্রোগ্রাম চলছে। ধীরে ধীরে প্রোগ্রাম খুবই সাকসেসফুলভাবে শেষ হলো। আমরা ভীষণ খুশি। অনেক রাত হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে আমাদের জিনিসপত্র ওরা ধরে ধরে আমাদের নিয়ে যাওয়া বাসে তুলে দিলো।
আমরা রওনা দিবো ঢাকায়। হঠাৎ ওই অতি উৎসা হী ছেলেটা এসে আমাদের প্রচণ্ড রিকোয়েস্ট শুরু করল, ওর বাসায় ১০ মিনিটের জন্য যেতে। ও বলল, ওর আম্মা আমাদের জন্য খাবার রেডি করে রেখেছেন। অর্গানাইজারও রিকোয়েস্ট শুরু করল ওখানে যেতে।
এত বলাবলির পর আমরা এক পর্যায়ে রাজি হলাম। আমরা ওর বাসায় গেলাম। বাসাটা বেশ বড়। বিরাট আঙিনা পার হয়ে মূল বাসা শুরু। ইতোমধ্যে আমাদের কানে স্থানীয়রা দিয়ে দিয়েছে যে, ওই ছেলেটা স্থানীয় এমপির ছেলে। তবে আমি ওকে দেখে শিওর হয়ে গেলাম যে, শুধু ডাইল না, সাথে ম্যানড্রেক্সও মারসে! কথাবার্তা একেবারে জড়ানো, ঢুলু ঢুলু চোখ। মাঝে মাঝে একটু দুলছে।
আমাদের ওই সময় ইয়াবার উৎপত্তি হয় নাই। তখনকার নেশা ছিল ডাইল এবং অনেকে ম্যানড্রেক্স নামের একটা ট্যাবলেট খেত নেশা করার জন্য। যারা গরিব নেশাখোর, তারা সোনারিল নামের ট্যাবলেট দিয়ে নেশার জীবন চালিয়ে নিত। নেশাকে আরও চাঙা করার জন্য অনেকে ডাইলের সাথে ম্যানড্রেক্সও খেত। অর্গানিক নেশা হিসাবে গাঁজা সব সময় ছিল। গাঁজা ছিল বেসিক নেশা হিসাবে। যারা গাঁজা খেত বা এখনো খায়, তাদের কাছে শোনা যেত এবং এখনো যায় যে, গাঁজাতে কোনো ক্ষতি করে না শরীরের। গাঁজা খাওয়ার পর দুধ খেয়ে নিলে সব কিছু কাভার!
…
চোখের
সামনে এক্সট্রিম
নেশা করে মরে যেতে
দেখেছি খুব ঘনিষ্ঠ
বন্ধুকে
…
আমার জানামতে, নার্ভ সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে দেয় গাঁজা। আসলে প্রত্যেকটা নেশাই অসম্ভব খারাপ। আমার চোখের সামনে এক্সট্রিম নেশা করে মরে যেতে দেখেছি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। নেশা কোনোদিনও ভালো না।
***
ওদের বাসায় গিয়ে ঢুকলাম। (সম্ভবত ওর নাম ছিল টিপু।) ওরা বসাল ড্রইংরুমে। এমপি সাহেব এলেন সস্ত্রীক। আমাদের সম্ভাষণ জানালেন। দুয়েকটা কথা বলার পর আমাদের নিয়ে গেলেন খাবার ঘরে। সবাই ডাইনিং টেবিলে বসলাম। আমার অসম্ভব লজ্জা লাগছিল এভাবে হঠাৎ করে অপরিচিত মানুষের বাসায় একেবারে খেতে চলে যাওয়ার কারণে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার ড্রইংরুমে বসলাম। এমপি সাহেবের স্ত্রী বললেন: ‘বাবা, একটা গান শোনাও। আমি তোমার গান শুনি নাই আগে।’
আমরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করলাম। টিপুও বলল: ‘ভাই, শোনায়া দেন দুইটা।’

না করতে খুব লজ্জা লাগল আমাদের গায়কের। এইমাত্র খেয়ে উঠেছি, ঢেকুরও তুলছি, না করি কীভাবে! মনে পড়ে গেল একটা প্রবাদ, ‘পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে।’ একটা অ্যাকুয়েস্টিক গিটার দিয়ে গায়ক শুরু করল গান। দুয়েকটা গান শুনিয়ে থামল ও।
আমি টিপুকে বললাম, আমরা এখন রওনা দেব। টিপু বাধ সাধল: ‘ভাই, আজ থেকে যান। এত রাতে কি যাবেন! সকালে উঠে চলে যেয়েন।’
আমি বললাম: ‘না, না, আমাদের যেতেই হবে, সকালের মধ্যে সব ইনস্ট্রুমেরন্ট ফেরত দিতে হবে।’
টিপুর বাবা-মাও থাকার জন্য রিকোয়েস্ট শুরু করলেন। ব্যান্ডের সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করলাম। এ রকম কারও বাসায় ব্যান্ডসহ থেকে যাওয়ার প্রস্তাব তো আগে পাই নাই, আর তাছাড়া আমরা সব সময় হোটেলে থেকে অভ্যস্ত, কারও বাসায়… না, না, না, ব্যাপারটা কেমন যেন লজ্জাকর ও বিব্রতকর অবস্থা।
টিপু তো নাছোড়বান্দা, কিছুতেই শুনবে না। ও বলতে থাকল: ‘না, আপনাদের থাকতেই হবে, এত রাতে যাওয়া খুব রিস্কি। সকালে চলে যেয়েন।’
ওর বাবা-মারও ওই একই কথা: ‘বাবারা, থেকে যাও, সকালে নাস্তা করে চলে যেও।’
ওনারা যথেষ্ট ভদ্রতা দেখাচ্ছিলেন। আমি শিওর, ওনারা জানেন না যে, ওনাদের চোখের মণি চামে-চামে ম্যানড্রেক্স খায়।
সবাইকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম: ‘কী করবি?’
ওরা: ‘চল, থাইকা যাই, সকালে উইঠা যামুগা। আর কয় ঘণ্টা, এখনি তো রাত দুইটা বাজে।’
আমি: ‘ঘুমাইলে তো আর এত সকালে উঠতে পারুম না, উঠতে উঠতে তো মিনিমাম ১১টা বাজব।’
ওরা: ‘বাযুগ, কি অসুবিধা? যাইতে ৩ ঘণ্টা লাগব। বিকালে ফেরত দিয়া দিমু সব ইনস্ট্রুমেন্ট।’
আমি: ‘আর লাকী ভাই? উনি তো মারব, না কইয়া কুমিল্লা নিয়া আইসি ওনার এম্প…।’
ওরা: ‘ওনার ভাড়া ডাবল কইরা দিমু।’
আমি: ‘তাইলে কি ইনস্ট্রুমেন্ট আমাগো সাথে এই বাসায় নিয়া ঢুকামু?’
ওরা: ‘এত রাতে আবার ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়া টানাটানি করুম?’
আমি: ‘তাইলে? কী করবি?’
আমাদের সাথে আমাদের এক বন্ধু গিয়েছিল, ও কিছু বাজাত না, কিন্তু সাথে সাথে থাকত। ও বলল: ‘আমার কথা হইলো এই বাসায় থাকিস না, রওনা দিয়া দেই, চল। আর যদি তোরা থাকতেই চাস, তাইলে বাসেই রাইখা দে। হেলপার রে আমি ২০টা টাকা দিয়া দিতাসি, ওই হালারে বাসে থাকতে কমু, তাইলেই হইব। এত রাতে আর টানাটানি করার দরকার নাই।’
টিপু বলল: ‘ভাই, কোনো অসুবিধা নাই বাসে রাখলে। আমাদের বাসার সামনে অনেক সিকিওরড, কিচ্ছু হবে না। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’
***
এক পর্যায়ে আমরা রাজি হয়ে গেলাম। বাসের ড্রাইভারকে টিপুদের বাসার একটা রুম দেওয়া হলো। বাসের হেলপার আমাদের বন্ধুর কথামতো বাসেই থাকবে বলে রাজি হলো। আমাদের রুম দেওয়া হলে দুটো। সবাই মিলে ওই দুটো রুমে ঢুকলাম।
…
চারিদিকে
কোনো সাড়া
শব্দ নাই, নিস্তব্ধ
রাত্রি, শুধু আমাদের
কয়েক জোড়া চোখ জেগে আছে
…
রুম থেকে সামনের আঙিনা ও বাসটা দেখা যাচ্ছে, যদিও অন্ধকারটা অনেক পুরো ছিল সেদিন। বাসার গেটের সামনে একটা লাইট পোস্ট। লাইট পোস্টটার টিমটিমে আলোয় বাসটা দেখা যাচ্ছে। অত বড় বাস বাসার আঙনায় ঢোকানো যায় নাই বিধায় বাসার সামনে কাচা রাস্তায় রাখা হয়েছে। আশেপাশে খুব একটা বাসা-বাড়ি নাই। ওদের বাসার পুরো এরিয়াটা ৩ ফিট উঁচু ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। অনেক বড় এরিয়া। সামনের আঙিনাটাও অনেক বড়। চারিদিকে কোনো সাড়া শব্দ নাই, নিস্তব্ধ রাত্রি, শুধু আমাদের কয়েক জোড়া চোখ জেগে আছে।
ধীরে ধীরে রাত আরও বাড়ে। আমাদের কারও ঘুম আসছে না। এপাশ-ওপাশ করছি। সারাটা পাড়া ঘুমিয়ে গেছে। আমি সিগারেট ধরালাম। আমার সাথে ওরাও। সিগারেট শেষ করে হয়তো আরও কিছুক্ষণ জেগে ছিলাম, তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না।
***
সকাল বেলা ধড়ফড় করে উঠে বসলাম আমি। ওদের ডাকতে শুরু করলাম। ওরা উঠে পড়ল। সকাল ৯টা হবে। বাসার অন্য কেউ উঠেছে বলে মনে হলো না। আমরা নাস্তা না করে রওনা দেওয়ার ডিসিশন নিলাম। পথে সারা হবে নাস্তা।
ফ্রেশ হয়ে বাসার দারোয়ানকে বললাম ওনাদের ডাকার জন্য। ইতোমধ্যে ব্যান্ডের দুয়েকজন বাসে গিয়ে উঠেছে। আমরা বাসার সামনের বারান্দায় ওনাদের জন্য অপেক্ষা করছি। একজন ব্যান্ড মেম্বার হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে বললো: ‘টুলু ভাই, একটা ঘটনা ঘটসে!’
আমি: ‘কী হইসে?’

ও: ‘আসেন বাসে।’
আমরা সবাই দৌড়ে বাসে গিয়ে উঠলাম। গিয়ে দেখি, সব আছে ঠিকঠাক, শুধু বেজ এম্প’টা নাই। কোথাও নাই বাসের। ছাদে খুঁজলাম; না, পাওয়া গেল না কোথাও। বাসার ভেতরে তো নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাইলে গেল কই?
বেচারা হেলপার তো আকাশ থেকে পড়ল। কিছুই বলতে পারল না। আমরা ভীষণ টেনশনে এ পড়ে গেলাম। আর তার মধ্যে পড়বি তো পড়, মালির ঘাড়ে– লাকী ভাইয়ের এম্প’টাই নাই! চোখের সামনে লাকী ভাইয়ের গানটা মনে পড়ে গেল, ‘এই নিল মনিহার…’। বুইঝা গেলাম, লাকী ভাইতো ওই মনিহার দিয়াই আমারে বাইন্দা রাখব!
***
আমার বন্ধু যে আমাদের সাথে থাকে, হঠাৎ করে এসে হেলপারকে ধরে চরম মারতে শুরু করে দিলো। আর বলতে থাকল, ‘ওই শালার পো, কই রাখসস ক, তোরে মাইরাই ফালামু, বাঁচতে হইলে ক, তুই আইজকা শেষ…!’
আমরা কিছুতেই পারছি না ওকে আটকাতে। আমাদের সবাইকে ও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে রীতিমতো মারামারি শুরু করে দিলো। আমরা জানতাম, ওর অসম্ভব মাথা গরম এবং অসম্ভব সাহসীও। ও আমাদের চিৎকার করে বলল: ‘ওই হালারা বাস থেইকা সবাই নাইমা যা, আমারে আটকাইলে লাত্থি দিয়া বাস থেইকা ফালায়া দিমু তোগো! এই হালারে আমি মাইরাই ফালামু! এই হালায় লইসে। হালায় বাসে থাকল, আর কয়– কিচ্ছু জানি না…!’
***
এত হইচই দেখে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। এমপি সাহেব আর তার স্ত্রীও চলে এসেছেন। বাসার সবাই চলে এসেছে। শুধু খেয়াল করলাম, টিপু আসে নাই; হয়তো তখনো ঘুমাচ্ছে।
ওনারা এসে আমার বন্ধুকে থামানোর চেষ্টা করলেন। বন্ধুর কোনো হুঁশ নাই, ও মারধর সমানে চালিয়ে যাচ্ছে আর বলছে: ‘তোরে আমি মাইরাই ফালামু, ক কই রাখসস?’
আমাদের দিকে তাকিয়ে বন্ধু বলল: ‘ওই, পুলিশ ডাক, হালারে ৫ বছর জেল খাটামু।’
হেলপার এতক্ষণ শুধু বলছিল: ‘স্যার, আমি জানি না, আমি চুরি করি নাই।’ পুলিশের কথা শুনে বলে উঠল: ‘স্যার, আমি করি নাই!’
বন্ধু: ‘কে করসে? ক কে করসে?’
হেলপার: ‘এই বাসার ছ্যাড়াটা!’
বন্ধু: ‘কোন ছ্যাড়া?’
হেলপার: ‘যে আপনাগো এই বাসায় লইয়া আইলো, ওই ছ্যাড়া।’
বন্ধু: ‘কে? টিপু?’
হেলপার: ‘হেই ছ্যাড়ার নাম জানি না। এই বাসা হেগো।’
বন্ধু: ‘ও কী করসে?’
হেলপার: ‘হে রাইতে আইসে, আয়া আমারে কয় এম্পটা বাস থেইকা নামায়া দিতে। আমি না করসি। হে আমারে একটা চটকনা দিসে আর কৈসে, তোরে মাইরা ফালামু। আমি ডরে নামায়া দিসি। আমারে হে ২০০ টাকা দিসে। আমি জানি না কই লইয়া গেসে ওইটা।’
আমাদের এক ব্যান্ড মেম্বার বলে উঠল: ‘তুই কেন লাকি ভাইয়ের এম্পটা নামিয়ে দিলি? তুই অন্য একটা নামিয়ে দিতে পারতি!’
আমি ব্যান্ডের ওই মেম্বারের দিকে তাকিয়ে বললাম: “তুই কি ছাগল নাকি? ও কি জানে কোনটা লাকী ভাইয়ের? আর ও কি লাকি ভাইরে চিনে? ও কি ‘এই নীল মনিহার’ শুনসে? ও ম্যাক্সিমাম শুনতে পারে ‘ও দরিয়ার পানি, তোর মতলব জানি’…।”
বন্ধু আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল: ‘দেখসস, ঠিকই বাইর কইরা ফালাইসি! তোরা গান করস, গান করবি, সব কিছু লইয়া কথা কইবি না। আমারে আটকাইতে চেষ্টা করতেসিলি কেন? আটকাইলে বাইর করতে পারতি? অহন ডাক হালা টিপুরে! ওরে খায়াই ফালামু!’
আমি: ‘না, না, দোস্ত, মাথা ঠাণ্ডা কর। এমপি বাইন্দা রাখব ওনার পোলারে এইখানে পিটাইলে।’
সবাই আমাকে সমর্থন করল, ওই বন্ধু ছাড়া। ও মারবেই ওকে। এদিকে হেলপার তো ভেউ ভেউ করে কাঁদছে।
এমপি সাহেবকে ব্যাপারটা বললাম। উনি বুঝতে পারলেন। লোক পাঠালেন বাসার ভেতর, টিপুকে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য। ওরা গেল টিপুকে ডাকতে। সারা বাড়ি খুঁজেও ওরা টিপুকে পেল না। টিপু বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
দারোয়ান বলল: ‘ভাইয়ে তো রাইতে গেসে, আর আসে নাই।’
আমার বন্ধু বলে উঠল: ‘বুঝছি দোস্ত, এই হালায় কামটা করসে। আগেই কইসিলাম রাইতে থাকিস না কারও বাসায়। শুনলি না। পাগল হয়া গেলি থাকার লেইগা!’
***
এমপি সাহেব মনে হয় অবহিত ছিলেন ছেলের ব্যাপারে; তাই বাসার লোকদের বললেন, ছেলের রুমসহ সারা বাসা খুঁজতে এম্পটা। সবাই খুঁজতে থাকল। আমাদের ড্রামার কি মনে করে যেখানে বাসটা রাখা ছিল, তার আশেপাশের ঝোঁপ ঝাড়ে খুঁজতে শুরু করল। বাস থেকে ঠিক পঞ্চাশ ফুট দূরের রাস্তার পাশের একটা ঝোঁপের ভেতর থেকে উদ্ধার করে ফেলল এম্পটা। সবাই খুশিতে চিৎকার করে উঠলাম। এম্পটা এনে উঠানো হলো বাসে। টিপুকে আর না খুঁজে ওর বাবার কাছে বিদায় নিলাম আমরা। এসব নিয়ে আর কথা তুললাম না। কারণ ইতোমধ্যে অনেক সিন-ক্রিয়েট হয়ে গেছে। বাকি সব যন্ত্রপাতি ঠিক ছিল; তাই আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বাসে উঠে বসলাম। ড্রাইভারকে বললাম: ‘রওনা দিয়া দাও।’
হঠাৎ করে ড্রাইভার এবার বেঁকে বসলো: ‘না, আমি যামু না।’
আমরা: ‘কেন? তোমার আবার কী হইল?’
ড্রাইভার: ‘আপনারা আমার হেলপাররে মারলেন কেন? আমি যামু না আপনাগো লইয়া। আপনারা অন্য বাস ভাড়া করেন।’
আমার সেই বন্ধু আবার রেগে গেল চরম, এবং বলল: ‘ওই শালা, যাবি না? মাথায় ঠেকায়া গুল্লি করুম!’
ড্রাইভার কিছুতেই যাবে না। বন্ধু আমার ড্রাইভারকে ধরে টানতে টানতে বাসে উঠিয়ে ড্রাইভারের সিটে বসিয়ে বলল: ‘গাড়ি চালা; না হইলে তোরে মাইরাই ফালামু।’
ড্রাইভার গজ গজ করতে থাকল। বন্ধু গিয়ে ঠিক ইঞ্জিনের ওপর বসে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল। আমরা ওকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছিলাম না। ও রীতিমত পাগল হয়ে গেছে রাগে।
ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিল। বন্ধু এসে আমার পাশে বসল। ড্রাইভার ভীষণ বেসামালভাবে বাসটা চালাতে চালাতে ঠিক মাত্র ৫০০ গজ গেল এবং হঠাৎ করে রাস্তার পাশের একটা নিচু জায়গায় ধপাস করে বাসটা ফেলে দিয়ে একটা গাছের সাথে লাগিয়ে দিলো। আমরা সবাই হুড়মুড় করে সিট থেকে ছিটকে এদিক-সেদিক পড়ে গেলাম। সব ইনস্ট্রুমেন্ট লন্ডভন্ড হয়ে ছিটকাযে পড়ে গেল বাসের ভেতর। ড্রাইভার বাস থেকে নেমে দৌড় দিলো!
আমার বন্ধুটাও বিদ্যুৎগতিতে ওর পিছন পিছন দৌড় দিলো ধরার জন্য, পিছে পিছে আমরাও। কিন্তু পারলাম না। শালা ড্রাইভিংয়ের সাথে সাথে দৌড়ও প্রাকটিস করত মনে হয়! তা না হলে মাঠের মাঝখান দিয়ে কী ভাবে এত তাড়াতাড়ি ছোট হয়ে হারিয়ে গেল!
আমরা ফিরে এলাম। আমাদের পরিচিত একজন কুমিল্লা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। ওনাকে ফোন দিলাম, ঘটনাটা জানালাম। উনি আমাদের আরেকটা বাস পাঠিয়ে দিলেন এবং বাসের সাথে একটা টহল পুলিশের গাড়ি দিলেন বেশ বহুদূর পর্যন্ত পাহারা দিয়ে পার করে দেওয়ার জন্য। কারণ ওই ড্রাইভার যাতে বাস ড্রাইভার সমিতির সাথে আতাত করে আমাদের কোনো ক্ষতি না করতে পারে।
***
পরে কী হয়েছিল ওখানে, আমরা জানতে পারিনি; তবে টিপুকে আমরা ভুলতে পারিনি। এখনো মনে পড়ে টিপুর সেই ভদ্র চেহারাটা।
বাসটা ছেড়ে দিলো। সামনে একটা পুলিশের গাড়ি। নিজেদেরকে প্রেসিডেন্ট মনে হলো! সবাই আবার সেই আগের মতো ফাজলামি শুরু করে দিলাম, শুধু আমার বন্ধু বাদে। ওর রাগটা তখনো যায় নাই।

রওনা দিতে দিতে বিকেল হয়ে গিয়েছিল। সূর্যটা লাল হয়ে পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছিল। একটা সময় সবার কথা বলা থেমে গেল। যে যার মতো নিজের জগতে হারিয়ে গেল। ড্রাইভার নীরবতা দেখে ওর ক্যাসেট প্লেয়ার একটা গান ছেড়ে দিলো। গানটা শুনে সবাই আমরা এক প্রকার উন্মাদ হয়ে গেলাম। নুতন বেরোনো ক্যাসেট। আমরা সবাই অভিভূত হয়ে গেলাম। বারবার একই গান বাজাতে বললাম ড্রাইভারকে। ও বাজাতে থাকল গানটা। গানটার প্রথম লাইন ছিল, ‘নীলাঞ্জনা, ওই নীল নীল চোখে চেয়ে দেখো না…’।
এখনো যখনই শুনি গানটা, তখনই প্রথম মনে পড়ে ইশতিয়াককে এবং সাথে কুমিল্লার প্রোগ্রাম; অথবা যখনই মনে পড়ে কুমিল্লার প্রোগ্রামের কথা, তখনই মনে পড়ে যায় ইশতিয়াকের কথা। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আমাদের প্রিয় ইশতিয়াক, ঠিক যেমন হারিয়ে গেছে আমাদের প্রাণের বন্ধু নিলয়। আমরা এখনো জীবনের ঘানি টেনে চলছি অজানার উদ্দেশে।