মূল: ফ্রেডি মার্কারি
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
অনুবাদকের ভূমিকা
ফ্রেডি মার্কারি [৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬–২৪ নভেম্বর ১৯৯১]। মিউজিক দুনিয়া উলট-পালট করে দেওয়া ব্রিটিশ রকস্টার। ‘কুইন’ ব্যান্ডের ফ্রন্টম্যান। অতি আলোচনা ও সমালোচনামুখর নাতিদীর্ঘ জীবনে নিজেকে পরিণত করে গেছেন রক মিউজিক দুনিয়ার দুর্ধর্ষ কিংবদন্তিতে। তার আত্মকথনমূলক লেখালেখি নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ‘অ্যা লাইফ, ইন হিজ ওন ওয়ার্ডস’ নামে একটি বই। ২০০৬ সালে বইটি প্রথম প্রকাশ করে মার্কারি সংস লিমিটেড। সে বইয়ের ধারাবাহিক অনুবাদের তৃতীয় কিস্তি হাজির করা হলো এখানে…
আগের কিস্তি: ফ্রেডি মার্কারির জার্নাল [১] । ফ্রেডি মার্কারির জার্নাল [২]

আধুনিক দুনিয়ায় আমার অবস্থানে থাকা লোকেরা নিজেদেরকে গ্রুপের ‘ফোকাল পয়েন্ট’ বলে পরিচয় দেন। আপনার নাম যদি রড স্টুয়ার্ট হয়, আর আপনার যদি কোনো ব্যাকিং ব্যান্ড থাকে, তাহলে ব্যাপারটা ঠিক আছে। কিন্তু ফ্রেডি মার্কারি ও তার ব্যাকিং ব্যান্ডের ক্ষেত্রে এমনটা ভাবার কোনো মানেই হয় না।
আপনি এই ব্যান্ডকে বিশ্লেষণ করলেই টের পাবেন, পুরো কাজ আমরা চারজনে মিলেই করি। প্রতিজনের অবদান ২৫ শতাংশ করে; আর আমি ফ্রন্টে দাঁড়াই, এই যা। কুইন একটি চারমুখী জিনিস; তবে ব্যাপারটি (সামলানো) যে খুবই কঠিন, সে কথা স্বীকার করে নিচ্ছি। বারবার কোনো চারমুখী পরিস্থিতি থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ কথা নয়; তবে কখনো কখনো আপনাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা মেনে নিতে হবে।
আমাদের মধ্যে হরদমই মতানৈক্য ঘটে। কখনো কখনো আমরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যাই; কিন্তু সেক্ষেত্রে কী উপায়? আমরা তেমন বিষয়কে কিছুকালের জন্য পেছনে ফেলে রাখি, পরে আবার সেটা নিয়ে ভাবা যাবে বলে।
…
আমরা
দুনিয়ার
সবচেয়ে
‘কুত্তামার্কা’ ব্যান্ড
…
আমাদের মধ্যে সবসময়ই তর্ক লাগে। আক্ষরিক অর্থে একেবারে প্রথম দিনই আমরা ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিলাম। আমাদের চারজনের প্রত্যেকেরই ভীষণ দাপুটে ব্যক্তিসত্তা রয়েছে; তাই আমরা স্রেফ একে অন্যের সঙ্গে লেগে যাই। ব্যাপারটা যেন চারটা মোরগের লড়াই লাগার মতো। আমরা দুনিয়ার সবচেয়ে ‘কুত্তামার্কা’ ব্যান্ড! আমরা একে অন্যের ঠোঁটের কাছে ঠোঁট এগিয়ে নিই ঝগড়া করতে করতে। তবে যদি আমাদের মধ্যে মতানৈক্য না থাকত, সবকিছুতেই যদি ‘জি হুজুর’ টাইপ হতাম আমরা, তাহলে শেষ পর্যন্ত বসে বসে মাখন খেতে পারতাম!
সাধারণত সব ধরনের আত্মঅহংকার, ক্রুদ্ধতা ও বদমেজাজ আমার বৈশিষ্ট্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে। আমি খুবই আবেগপ্রবণ মানুষ। নিশ্চিতভাবেই ভীষণ মাথাগরম এক লোক আমি। তবে গ্রুপের অন্যদের কাছ থেকে আপনি যা পাবেন, তা আপনাকে কখনো কখনো চমকে দিতে পারে। আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ব্যক্তিগত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যমূলক বৈশিষ্ট্য; তবু এটিই বোধহয় আমাদেরকে এক সুতোয় বেঁধে রাখে।

আমার ধারণা, আমরা এখন একে অন্যের সঙ্গে যথেষ্ট অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি; স্রেফ সহজাত প্রবৃত্তিই আমাদের একসঙ্গে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে। মূলত, আমরা চারটা লোক একসঙ্গে কাজ করি। এখানে বড় ধরনের কোনো বন্ধন নেই; আমরা খুব একটা সামাজিকীকরণের ধার-ধারেও থাকি না।
দিনে দিনে বহুদিন হয়ে গেল আমরা একসঙ্গে থাকছি, আক্ষরিক অর্থেই প্রতিদিন একে অন্যকে দেখছি, পেশাদারি জায়গা থেকে অবশ্যই। তবে আমার ধারণা, সামাজিকতার প্রশ্নে একে অন্যের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করি; কেননা, অন্যথায় আমাদের পরস্পরের কাছে পরস্পরকে ভীষণ একঘেঁয়ে লাগতে শুরু করবে।
কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের যাওয়ার যদি দরকার পড়ে, সেক্ষেত্রে সেটিকে আমরা ভীষণ পেশাদারভাবে নিই। অন্যথায়, আমরা যে যার মতো করেই (সামাজিক জীবন) কাটাতে পছন্দ করি। (গ্রুপের) অন্য সদস্যদের যার যার পরিবার আছে, তারা তাদেরকে সময় দেয়; আর বরাবরের মতোই পরিবারের কাছ থেকে নিজের ‘গোপনীয়তা’ বজায় রাখতে আমি পছন্দ করি। বুঝতেই পারছেন, কী বোঝাচ্ছি।
সারাক্ষণ একই জায়গায় জীবন কাটাতে পারি না আমি। আমাদের কাজের জন্য আমরা সবসময়ই একে অন্যকে দেখি; আর, আপনার জীবনে যদি সারাক্ষণ সেই একই মানুষ ঘোরাফেরা করে, তাহলে নিশ্চয় আপনি পাগল হয়ে যাবেন? তাই কাজ শেষ হওয়ামাত্র আমি আমার রাস্তায় হাঁটা দিই, ওরা ওদের রাস্তায়। এমনটাও সম্ভব, ওদের সঙ্গে আমি মাসের পর মাস হয়তো কথা বললাম না; তারপরও আমরা কোনো ট্যুরে গিয়ে ঠিকই একসঙ্গে জ্বলে ওঠব।
…
জানি,
যদি চিরকাল
একসঙ্গে থাকি,
একে অন্যের নাভিশ্বাস
তুলে ফেলব
…
মিউজিকই আমাদের এভাবে একসঙ্গে বেঁধে রাখে; আমরা এখন একে-অন্যকে সহজাত প্রবৃত্তিতেই মেনে নিতে শিখে গেছি। আমরা জানি, যদি চিরকাল একসঙ্গে থাকি, একে অন্যের নাভিশ্বাস তুলে ফেলব।
একটা সময় ছিল, যখন প্রচুর সংঘাত বাঁধত; তবে পরে সেটা এক ধরনের ঘঁষামাজা করে ঠিক করতে পেরেছি। হ্যাঁ, প্রচুর তর্ক আমরা করি, প্রচুর ঝগড়া করি; তবে শেষ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো– এসবের ভেতর দিয়ে কিছু প্রোডাক্ট, কিছু ভালো জিনিস বের করে আনি। নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার করি আমরা।
‘হ্যাঁ, আমরাই সর্বসেরা!’– গরিমা দেখিয়ে এমন কথা বলে ফেলা খুবই সহজ। অহংকার দাঙ্গা ডেকে আনতে পারে; এটি এ ধরনের যেকোনো কাণ্ডই ঘটাতে পারে; তবু আপনাকে মাটিতেই পা রাখতে হবে। আমার ধারণা, এটাকেই বোধহয় বলে– পেশাদারিত্ব।
মিউজিকের দিক থেকে আমরা এখনো একে অন্যকে শ্রদ্ধা করি, আর এটাই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের চারজনের বৈশিষ্ট্য একদম চার ধরনের, তবু তাতে কিছুই যায়-আসে না। মিউজিক্যালি আমরা যদি একমত হতে না পারি, এমন পরিস্থিতিতে মেজাজ চড়ে যায় ঠিকই, তবু যদি একই রুমে অন্যদের পাশে শেষ পর্যন্ত আপনি দাঁড়িয়ে থাকতে না পারেন, তাহলে বরং আপনার বলতেই হবে, ‘বাদ দিই।’ এ স্রেফ নিপীড়ন।

আসলে, কোনো একটা অ্যালবামের কাজ শেষ হলে আমরা ভাবতে শুরু করি, ‘আচ্ছা! আমার নিজের ভাবনা আছে, ওর নিজের ভাবনা আছে; তবে মিউজিকের খাতিরে শেষ পর্যন্ত আমরা একত্রিত হতেই পারি।’
আমাদের মতো কোনো ব্যান্ডে যদি চারজন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সদস্য থাকেন, তারা প্রত্যেকেই চাইবেন ভিন্নতর ছোঁয়া রাখতে, আর সেটা সামলানো খুবই মুশকিল। কারও অহংবোধ বহুদূর এগিয়ে গেলে, সেখান থেকে ফিরে আসার সুযোগ না থাকার কারণেই মূলত কোনো ব্যান্ডে ভাঙন ধরে। সেখানে যদি কোনো দাপুটে লোক থাকেন, বাকিরা তখন ভাবেন, ‘এই ফালতু লোকটা তো অনেক বেশি দাপুটে, আমরা বরং অন্য কোনো ব্যান্ডের চেষ্টা চালাই।’ আমরা তাই কোনো না কোনোভাবে যে যার অহংবোধ নিয়ন্ত্রণে রাখি।
তার মানে এই নয়, সবকিছুতেই একমত হওয়ার মতো একঘেঁয়ে লোক আমরা; তবে (দ্বিমতকে) বেশিদূর এগোতে না দিয়ে উল্টো বলি, ‘আচ্ছা, বাদ দাও!’ এমনও দিন গেছে, কোনো একদিন আমারও এমন কথা বলে ফেলা উচিত বলে ভেবেছি আমি; তবে মিউজিকের প্রশ্নে আমরা আরও বেশি কিছু করতে চাই বলেই মনে হয়েছে আমাদের।
আমার ধারণা, আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে চাই না বলেই এতদিন ধরে একসঙ্গে থাকতে পারছি। যদি আপনি চলে যান, সেটি কাপুরুষের কাণ্ড হবে। আমার নিজের ভেতরে এবং আমাদের পুরো ব্যান্ডের ভেতরে টিকে থাকার একটা সহজাত প্রবৃত্তি রয়েছে।
ব্রায়ানের কাছে একবার (১৯৭৫ সালে) স্পার্কস ব্যান্ডের কাছ থেকে ডাক এসেছিল; সে বলেছিল, ওই ব্যান্ডের লোকেরা চান সে যেন গিটারিস্ট হিসেবে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তবে আমরা এ ধরনের বিষয়ের সঙ্গে প্রতিদিনই ও জাগতিকভাবে বোঝাপড়া করে অভ্যস্ত। আমরা যা করি, সেই কাজে এত বেশি জড়িয়ে থাকি, দ্বিতীয় কোনো ভাবনা আসে না আমাদের। অন্য ব্যান্ডে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব আমাদের প্রত্যেকের কাছেই এসেছে; কিন্তু আমরা সেইসব প্রস্তাবকারীর মুখ স্রেফ গোমড়া করে দিয়েছি।
…
আমি আগে থেকেই
কটু কথায় ওস্তাদ;
তবু ব্যান্ড ছেড়ে
যাওয়ার
কথা
মিথ্যে
করেও, এক
মুহূর্তের জন্যও বলি না
…
ব্রায়ান তার সিদ্ধান্ত জানাতে খানিকটা সময় নিয়েছিল; তাই তারা সেটিকে নিয়ে ভুল ধারণা মনে পোষেছিলেন। ব্রায়ান আসলে সত্যিকার অর্থেই একজন ভীষণ ভদ্রলোক; আমি কিন্তু তা নই। আমি আগে থেকেই কটু কথায় ওস্তাদ; তবু ব্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার কথা মিথ্যে করেও, এক মুহূর্তের জন্যও বলি না।
একমাত্র যে কারণে ব্রায়ান কুইন ছাড়তে পারে, তাহলো– যদি সে জ্যোতির্বিদ হয়ে ওঠতে চায়; স্পার্কস বা অন্য কোনো ব্যান্ডে যোগ দেওয়ার জন্য নয়। হায় ঈশ্বর! বিশেষত স্রেফ মজা করার জন্যই এসব বলে সে। আমরা এক ঢেউয়ের চূড়ায় উঠে বসেছিলাম; সবকিছু আমাদের জন্য ছিল সারিবদ্ধ। আর এর ফল হিসেবে অবশেষে বোঝা যেতে শুরু করল: মিউজিশিয়ান হিসেবে আমরা শ্রদ্ধাযোগ্য; আর, আমাদের গানগুলো সঠিক ধরনের লোকগুলোকেই দিচ্ছে নাড়া।

আমার ধারণা, নিজেদের ক্যারিয়ারকে যেভাবে আমরা মোকাবেলা করেছি, শুনতে ক্লিনিক্যাল ও হিসেবি বলে মনে হবে; অথচ আমাদের অহংবোধ নিজেদের ভেতর থেকে সেরাটা বের করে আনা ছাড়া অন্য কিছুই করতে পারেনি। নিজেদের আমি সবসময়ই একটি শীর্ষ গ্রুপ হিসেবে ভাবি। শুনতে খুবই মাথামোটা বলে মনে হচ্ছে, জানি; তবে ব্যাপারটি এ রকমই। মট দ্য হুপল-এর সঙ্গে যখন আমরা বাজানোর সুযোগ পেলাম, সেটি ছিল দারুণ ব্যাপার; তবে আমি বেশ ভালোভাবেই জানতাম, যে মুহূর্তে ওই ট্যুর শেষ হবে, ব্রিটেনের কথা বিবেচনায় নিতে গেলে, শিগগিরই আমরা সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠব।
ভিন্ন কিছুর আইডিয়া নিয়ে চেষ্টা চালাতে আমরা ভয় পাই না। একটি ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চিতভাবে পরিষ্কার জানি, তা হলো, একই ফর্মুলার পুনরাবৃত্তি। মূলত আমরা একটি রক ব্যান্ড; এ কারণেই ফার্ম অ্যালবামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। দ্বিতীয় অ্যালবামটি খানিকটা আলাদা; আর, যারা আমাদের তৃতীয় অ্যালবামটি শুনেছেন, তারা হয়তো ভাবতেও পারেননি– এগুলো আমাদের গান।
দেখুন, স্টাইলের পরিবর্তন সবসময়ই ঘটে। এই অজুহাত আমরা দিতেই পারি: কাজে লাগে– এমন ফর্মুলার মধ্যে লেগে থাকা উচিত আপনার, ফলে নতুন পর্যায়টি তবু সেই পুরনো স্টাইলই; অথচ তাতে আমরা এমন কিছু জুড়ে দিয়েছি, যেগুলো আমাদের এগিয়ে নিয়েছে। এটি কাজ করার একটি পন্থামাত্র। এটি সবকিছুর ক্ষেত্রেই খাটে, এমনকি শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেও। এ কথা আমি জোর দিয়ে বলছি।

হায় ঈশ্বর, শির হার্ট অ্যাটাক অ্যালবামের ছবি তোলার জন্য কী যন্ত্রণার ভেতর দিয়েই না আমরা গিয়েছি! শুনুন প্রিয়, নিজেদের শরীর ভ্যাসলিনের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে ফেলা, এবং তারপর পানির ঝরণা দিয়ে সেগুলো তুলে ফেলা– এমনটা করতে কাউকে শুনেছেন কখনো? এমন কাণ্ডের ফলাফল– ব্যান্ডের চার সদস্যকেই দেখতে লাগছিল একেবারেই উদ্ভট, তামাটে ও স্বাস্থ্যবান; যেন টানা এক সপ্তাহ ধরে ঘামে ভিটে চিটচিটে হয়ে গেছে তারা।
তবে ঘটনা হলো, ‘কুইন থ্রি’র কাভার হিসেবে এমন কোনো ছবিই আশা করছিল সবাই; আর এটি ছিল একেবারেই নতুন কিছু। তার মানে এই নয়, আমরা আমূল পাল্টে গিয়েছিলাম; বরং সে সময়ে একটি নতুন পর্যায়কালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম স্রেফ।
…
আমজনতার
রুচি কিংবা
অন্য
কোনোকিছুর দাসত্ববরণ করিনি
…
আমাদের মিউজিকের প্রবাহিত হওয়ার মতো বহু রাস্তাই রয়েছে। আমরা যা করতে চেয়েছিলাম, স্রেফ তা-ই করেছি– আমি এমনটাই মনে করি। আমজনতার রুচি কিংবা অন্য কোনোকিছুর দাসত্ববরণ করিনি। কী চলছে– সে ব্যাপারে সচেতন থাকার, এবং এক ধাপ সামনে আগানোর চেষ্টা করেছি আমরা। সেটি শেষ পর্যন্ত স্বয়ং মিউজিকের জন্য ভালো বলেই আমি মনে করি। আর, আমরা ভালো গান লিখি এবং সেগুলোকে দারুণভাবে বাজাই বলেও মনে করি।
আমরা আসলে প্রচুর ঝুঁকি নিয়েছি; আমার ধারণা, সেগুলোর বেশিরভাগের কাছ থেকেই পেয়েছি দাম। তবে বরাবরের মতোই এখনো আমরা নির্ভয়। যে রূপে শুরু করেছিলাম, এখনো তেমনই ফুলবাবু। স্রেফ লোকজনকে দেখাচ্ছি– আমরা কোনো মামুলি মেয়েলি-পুরুষ নই, বরং আরও অন্য কিছু করতে ও সাজতেও সক্ষম।
আমি মনে করি, যতবার আপনি নতুন কোনো অ্যালবাম বানাবেন, সেটি আপনাকে একটি নতুন প্রাণশক্তি এনে দেবে; আর, আমরা তো বানাই এমনতর ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অ্যালবাম। যখন এগুলোর কাজ শুরু করি, প্রতিবারই একেকটি নতুন প্রকল্পের মতো করে নিই। এ একেবারেই টাটকা; আগ্নেয়াস্ত্রে এ এক দুর্দান্ত শট। যদি সেই পুরনো ভাবনার সঙ্গেই সন্ধি করি সেটিকে নিরন্তর গ্রহণযোগ্য বা এ রকম কিছু ভেবে, তাহলে সেটা হবে নিরাপদে থাকার প্রচেষ্টা। আমরা কখনোই ‘নিরাপদ খেলা’ খেলি না।

হট স্পেস [১৯৮২] অ্যালবামে কীসব ঝুঁকি নিয়েছি, খেয়াল করে দেখুন। দারুণ ছিল সেটি। ভিন্ন ভিন্ন এলাকা ও বিক্রয় কেন্দ্র খুঁজে নিয়েছি আমরা; এভাবে আমাদের কর্মশক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় এক ধরনের প্রবাহমান করেছি। অথচ আমরা কিন্তু সেই পুরনো চারটা লোকই; তবু নানাদিক থেকেই অ্যালবামটি টাটকা। এ নিয়ে আমি বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম। অ্যালবামটা কালো মানুষের অধিকার আদায়ে জায়গা করে নেবে? ডিস্কোতে জায়গা করে নেবে? আমরা তা জানতাম না।
মনে পড়ে, অ্যানাদার ওয়ান বাইটস দ্য ডাস্ট [১৯৮০] গানটি যখন প্রকাশ পেল, আর চার্টে দখল করে নিল এক নম্বর জায়গা, তখন প্রচুর লোক এটা কিনেছি, আর ভেবেছে, নির্ঘাৎ আমরা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ। পরে আমাদের শো’তে এসে দেখে, আমরা সবাই শ্বেতাঙ্গ।
আমার ধারণা, হট স্পেস আমাদের নেওয়া সবচেয়ে বড় ঝুঁকিগুলোর একটি; তবে প্রচলিত প্রবণতার বাইরের কিছু এটাতে লোকে ঠিকই খুঁজে পায়। প্রচলিত নমুনার স্রেফ অনুসারী– এমন কোনো অ্যালবাম নিয়েই বারবার আমরা যদি হাজির হতাম, আমার একদমই ভালো লাগত না।
সবসময় আমরাই ঠিক– এ কথা বলছি না; কারণ, আমরা তা নই। এই পুরো ড্যান্স/ফাংক মুডের আইডিয়াটি মূলত আমারই ছিল; আর এটি খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে আমরা পারিনি। আমার ধারণা, এটি সময়ের চেয়ে আগুয়ান ছিল ঠিকই, তবে সে সময়ে আমরা যা করা উচিত বলে অনুভব করেছি, তা-ই করেছি, এবং সে সময়ে এটাকে আমাদের কাছে সঠিক বলেই মনে হয়েছে।
…
বহু
ট্রমার
ভেতর
দিয়ে যেতে
হয় আমাদের
…
বহু ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হয় আমাদের; তবু আমরা ভীষণ যত্নবান। একেকটি অ্যালবামের প্রশ্নে আক্ষরিক অর্থেই ১০ থেকে ২০টি গান বাতিল করে দেওয়া হয়; সেগুলোর মধ্যে দারুণ কিছু গানও বাদ পড়ে যায়। আমাদের জন্য বরাদ্ধ করা সময়কালে আমাদের গাওয়া গানগুলো লোকে যদি পছন্দ না করে, আমাদের তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না। আমরা যা করি, ভীষণ যত্নের সঙ্গেই করি; কেননা, সেগুলোর প্রতি ততটাই টান অনুভব করি। যদি দুর্দান্ত কোনো অ্যালবাম করে থাকি, সেক্ষেত্রে অ্যালবামটির প্যাকেজ যেন ঠিকমতো হয়– সেটা আমরা নিশ্চিত করি। সত্যি কথা বলতে, আমরা বোধহয় দুনিয়ার সবচেয়ে ব্যস্তবাগীশ ব্যান্ড।
যতবারই স্টুডিওতে ঢুকি, আমাদের জন্য ততবারই কাজকর্ম আরও বেশি কঠিন হয়ে ওঠে; কেননা, আমরা আগের চেয়ে আরেকটু সামনে আগানোর চেষ্টা চালাই, আগের চেয়ে একটু ভিন্ন ধরনের সাউন্ডের জন্য গান লেখার চেষ্টা চালাই। প্রথম অ্যালবামটি সহজ ছিল; কেননা, আপনার মাথায় তো তখন প্রচুর জিনিস, আপনি সেগুলো নামিয়ে ফেলার জন্য উদ্বিগ্ন। একের পর এক অ্যালবাম যখন হতে থাকবে, তখন ভাববেন, ‘লোকে বলবে, আমি একই ফর্মুলার পুনরাবৃত্তি করছি।’ এ ব্যাপারে আমি ভীষণ সতর্ক।

আরও ১০টা জিনিস করার ইচ্ছে জাগে আমাদের; অথচ একইসঙ্গে সেগুলো সব করে ওঠতে আমরা পারব না। এটা সম্ভব নয়। অ্যা নাইট অ্যাট দ্য অপেরা অ্যালবামে অল্প কিছুই করা সম্ভব ছিল, যা আমরা আসলে প্রথম অ্যালবামে করতে চেয়েছিলাম; তবে সেই চেষ্টা করা বেশির ভাগ মানুষের কাছেই বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। এক অ্যালবামের মধ্যে সবকিছু ঠেসে ভরে দিতে পারবেন না আপনি; আপনাকে সময় নিতে হবে।
স্টুডিওতে আমার ভালোলাগে; যদিও আমার জন্য এটিই সবচেয়ে শ্রমসাধ্য ব্যাপার। আমি ভীষণ পরিশ্রান্ত, মানসিকভাবে। এটি আপনাকে পুরোদস্তুর শুষে ফেলবে। মাঝে মধ্যে নিজেকে জিজ্ঞেস করি, কেন এসব করছি। শির হার্ট অ্যাটাক-এর পর আমরা উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম; বলেছিলাম, ‘আর কক্ষনো নয়!’
তারপর কী ঘটল, দেখুন!
ওই অ্যালবামের পর উপলব্ধি করলাম, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আমরা টের পেলাম, আর কোনো বাধা নেই, বিধিনিষেধ নেই। আওয়াজের দিক দিয়ে আমরা যেকোনো ব্যান্ডকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম; তাই ভাবলাম, নিজেদের পুরোপুরি উজাড় করে দেব: নিজেদের জন্য কোনো ধরনের বিধিনিষেধ রাখব না; যা করছি চাই, ঠিক তা-ই করব।
প্রতি অ্যালবামেই আমরা একটু একটু করে ভেসে যাচ্ছিলাম আসলে; কিন্তু এটাই তো কুইন-এর ধরন। অ্যা নাইট অ্যাট দ্য অপেরায় [১৯৭৫] টিউবা থেকে কোম্ব– সব ধরনের সাউন্ডেরই সমাহার ছিল। কোনোকিছুই সুরছাড়া নয়। অ্যালবামটি বানানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা জেনে গেলাম, যা কিছু করতে চাই– তাতে আর কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতা নেই।
পরের কিস্তি