মূল: ডেভ এভারলি ।। অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
রামস্টাইন
ন্যু ডয়চে হার্টে [নিউ জার্মান হার্ডনেস] ব্যান্ড; জার্মানি। ১৯৯৪–
বার্লিন দেয়াল ভেঙে ফেলার সময় কোথায় ছিলেন, ঠিকঠাক মনে আছে ফ্লেক লরেঞ্জের। দিনটি ৯ নভেম্বর ১৯৮৯। তিনি তখন তার পাংক ব্যান্ড ফিলিং বির হয়ে পশ্চিম বার্লিনের এক শোতে পারফর্ম করছিলেন। সেখানে অস্বাভাবিক কিছুই ছিল না, শুধু একটি ব্যাপার ছাড়া: ভবিষ্যৎ রামস্টাইন-এর এই কীবোর্ড প্লেয়ার ও তার ব্যান্ডমেটরা ছিলেন পূর্ব বার্লিনের মানুষ– যে শহর দশকের পর দশক ধরে নিজের পশ্চিমা যমজ শহরের কাছ থেকে শারীরিক, রাজনৈতিক ও আদর্শগতভাবে ছিল আলাদা।
কট্টরপন্থী সমাজতান্ত্রিক পূর্ব বার্লিনের দোরগোড়ার এ শহরকে হরদম দানবীয় হিসেবে চিত্রিত করা হলেও এটি যে আদৌ তা নয়, অধঃপতিত ও পুঁজিবাদী পশ্চিম বার্লিনকে তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য দুই শহরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা কংক্রিটের বেড়ার ভেতর একটি গিগে অংশ নেওয়ার অনুমতি পেয়েছিল ফিলিং বি। ব্যান্ডটি পারফর্ম করার সময় দর্শকসারিতে কিছু চেনা মুখের দেখা পান ফ্লেক; পূর্ব বার্লিনের ওই মুখগুলোর তখন ওখানে থাকার কথা নয়।
‘আমরা খেয়াল করলাম, আমাদের কিছু বন্ধু ওখানে এসেছে,’ মেটাল হ্যামারকে বলেন ফ্লেক। ‘আমি বললাম, কী করে ওরা পশ্চিম বার্লিনে এলো? এটা তো সম্ভব নয়। ওরা কি তাহলে (বার্লিন) দেয়াল লাফিয়ে পেরিয়ে এসেছে?’
তখন কেউ একজন তাকে জানালেন, সে রাতেই বার্লিন দেয়াল ভেঙে পড়েছে; দম্ভ নিয়ে প্রায় ৩০ বছর দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালটি গুড়িয়ে দিয়েছেন প্রতিবাদকারীরা। সে ছিল এক মহামূল্য ঘটনা, যদিও একটা ব্যাপার ফিলিং বির বাড়ি ফেরার পথে হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাধা। ‘সেটা সম্ভব ছিল না,’ বলেন ফ্লেক। ‘(বার্লিন) দেয়ালের ছিদ্রগুলো মানুষে মানুষে ভরে গিয়েছিল। এমনই হুলস্থুল অবস্থা, আমরা তখনই বাড়ি ফিরতে পারিনি। সে রাতটি পশ্চিম বার্লিনেই কাটাতে হলো আমাদের।’

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বার্লিন দেয়াল পতনের ঘটনাটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। জার্মানির পুনর্মিলনের স্ফুলিঙ্গ এবং এর প্রেক্ষিতে একগুচ্ছ ঘটনার সূত্রপাতই হয়তো সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙনের পরিশেষ এবং স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ডেকে এনেছিল।
তবে ফ্লেক ও ফিলিং বির ক্ষেত্রে এ ছিল আরও বেশি ক্ষতিকর প্রভাব। ‘এটি অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছিল,’ বলেন তিনি। ‘পূর্ব জার্মানির কেউই পূর্ব জার্মান ব্যান্ডগুলোর গান শুনতে চাইত না; কেননা, এখন তারা সত্যিকারের গান শোনার সুযোগ পেয়ে গেল। অতীতে যা কিছু ছিল নিষিদ্ধ, এ বেলা সবই ছিল সম্ভব। ফলে সবাই নতুন কিছু করার চেষ্টা চালাল।’
…
২৫
বছরেরও
বেশিকালের
পথচলায়, দিনে
দিনে এটি পরিণত হলো
সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে
দাপুটে ও সবচেয়ে
বিতর্কিত জার্মান
ব্যান্ডে
…
ফ্লেকও ছিলেন সেই লোকদের একজন। মাত্র কয়েক বছর পর তিনি ও তার দুই ফিলিং বি ব্যান্ডমেট– গিটারিস্ট পল ল্যান্ডারস ও ড্রামার ক্রিস্টোফ স্নাইডার এমন একটি নতুন ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করলেন, যেটির প্রোভোক্যাটিভ সাউন্ড ও ওয়াপেড, স্যাডডোনিক ওয়ার্ল্ডভিউ একইসঙ্গে ওই জাতির বিভাজিত অতীত এবং এর উজ্জ্বল ও ঐকবদ্ধ ভবিষ্যতের প্রতীকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গেছে। এই ব্যান্ডের নাম রামস্টাইন। ২৫ বছরেরও বেশিকালের পথচলায়, দিনে দিনে এটি পরিণত হলো সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে দাপুটে ও সবচেয়ে বিতর্কিত জার্মান ব্যান্ডে।
ফ্লেকের মতো রামস্টাইন গিটারিস্ট রিচার্ড জেড. ক্রুস্পও বেড়ে উঠেছিলেন তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে। তবে ফ্লেক যেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকারের অধীনে কাটানো জীবনকে ভালোবেসেছিলেন, সেখানে নিজ জন্মভূমির সঙ্গে রিচার্ডের সম্পর্কটি ছিল আরও বেশি জটিলতাপূর্ণ; তিনি বলেন, ‘জীবন ছিল ঝামেলা ও চাপ মুক্ত; জীবন ধারণের জন্য পর্যাপ্ত টাকাপয়সা ছিল আমাদের সবার।’
‘পূর্ব জার্মানির ব্যাপারটি এ রকম– ১২ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা ছিল দারুণ,’ ম্যাটাল হ্যামারকে বলেছিলেন তিনি ২০১৪ সালে। কৈশোরের শেষ বেলায় জন্মশহর শোয়েরিন থেকে পূর্ব বার্লিনে পাড়ি জমান রিচার্ড। বলেন, ‘একটি ভীষণ রকমের স্বাস্থ্যকর সমাজের মায়ার মধ্যে পড়ে গেছেন আপনি, যেখানে প্রশ্ন না তুললে জীবন কাটানো সহজ; আর ১২ বছর বয়স হওয়ার আগপর্যন্ত আপনি নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলবেন না।’
তারা দুজনেই একমত যে, রাজধানীতে একটি রোমাঞ্চকর আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক দৃশ্যপট ছিল। পূর্ব জার্মান কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যান্ডগুলোকে মিউজিক করার জন্য লাইসেন্সের আবেদন করতে বাধ্য করত। এ প্রক্রিয়ায় ৮-১০ জন স্যুট পরিহিত লোকে গড়া একটি কমিশনের সামনে তাদের বাজাতে হতো। ফিলিং বির মতো একটি শিল্পমনা ও লাইভওয়্যার ব্যান্ডের পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের লিরিক পাল্টে ফেলার এবং নিজেদের সবচেয়ে এনার্জেটিক গানগুলোর স্বর খানিকটা কোমল করে নেওয়ার মাধ্যমে অডিশনে ফাঁকি দেওয়ার সক্ষমতা ছিল। কিছু গানের ক্ষেত্রে তারা তা করেছেও।
‘প্রচুর ব্যান্ড ছিল সেখানে। আমরা সবাই ছিলাম সবার বন্ধু,’ স্মৃতিচারণায় বলেন ফ্লেক। ‘আমরা সবাই সবার সঙ্গে বাজাতাম। যখনই আমাদের কোনো গিটারিস্টের দরকার হতো, অন্য কোনো ব্যান্ড থেকে নিয়ে নিতাম।’

‘সেখানে প্রতিদিনই তৈরি হতো নতুন নতুন ব্যান্ড,’ বলেন রিচার্ড, যিনি রামস্টাইন-এর আগে ডাস এলিগেন্ট ক্যাওয়াস ও অর্গাজম ডেথ গিমিক ব্যান্ডে ছিলেন। ‘সেখানে প্রত্যেকেই অন্যদের সঙ্গে মিউজিক করত– এ রকম একটি দৃশ্যপট ছিল। আইডিয়াটা আমার মনে ধরেছিল। ভীষণ রকম রোমাঞ্চ, ভীষণ রকম মিউজিকের আনাগোনা।’
বার্লিন দেয়াল ভেঙে পড়ার পর সবকিছুই নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেল। আগে ওয়েস্টার্ন মিউজিক যেখানে রেডিওতে খুব সহজেই শোনা যেত, সেটির প্রতি ক্ষুধা আচমকাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল; কেননা এ বেলা এটি তো কণ্ঠস্বরেই সহজলভ্য হয়ে উঠল।
‘১৯৮৯ সালে (বার্লিন) দেয়ালটি যখন অবশেষে ভেঙে পড়ল, সেটি ছিল আমাদের সবার জন্য এক নতুন যুগের সূচনা,’ বলেছেন ডকুমেন্টারি মেকার কার্ল জি. হার্ড, যিনি ফিলিং বি ব্যান্ডের সঙ্গে প্রথম দেখা করেছিলেন আশির দশকের মধ্যভাগে। ‘তবে সহসাই আমরা বুঝতে পারলাম, পশ্চিমের [পশ্চিম জার্মানি] কেউই আসলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে নেই। পূর্ব জার্মান মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির অবকাঠামো পুরোদস্তুর ভেঙে পড়ল।’
…
‘সিস্টেমকে ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে
রসদ জুগিয়েছিল যাদের
মিউজিক, সেই
ইস্টার্ন
ব্যান্ডগুলো
এ বেলা এই নতুন
ও পুরোদস্তুর বাণিজ্যিকীকৃত
মিউজিক দুনিয়ায় পা রাখার জন্য
নিজেদের স্থানান্তর ও
পুনরাবিষ্কার
করতে বাধ্য
হলো’
…
‘পূর্ব জার্মান ব্যান্ডগুলোর জন্য কোনো চাহিদা ছিল না; পারফর্ম করার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধায় রাজত্ব করত ওয়েস্টার্ন ব্যান্ডগুলো। সিস্টেমকে ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে রসদ জুগিয়েছিল যাদের মিউজিক, সেই ইস্টার্ন ব্যান্ডগুলো এ বেলা এই নতুন ও পুরোদস্তুর বাণিজ্যিকীকৃত মিউজিক দুনিয়ায় পা রাখার জন্য নিজেদের স্থানান্তর ও পুনরাবিষ্কার করতে বাধ্য হলো।’
এই কার্যক্রমের সঙ্গে পথ চলার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিল ফিলিং বি। পুনর্মিলনকাল-উত্তর দুটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছিল ব্যান্ডটি: ১৯৯১ সালে উইর ক্রিগেন ইয়ুচ আলা [Wir kriegen euch alle; উই উইল গেট ইউ অল] ও ১৯৯৩ সালে ডি মাস্ক ডেস রোটেন টোডেস [Die Maske des roten Todes; দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ]। ফ্লেকের মতে, উভয় অ্যালবামই বার্লিন দেয়াল ভাঙার আগে মুক্তি পাওয়া তাদের যেকোনো অ্যালবামের চেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছিল।

তবে একই সময়ে, ফ্লেক, পল ও ক্রিস্টোফ আরও তিন জার্মান মিউজিশিয়ানের সঙ্গে জ্যামিং শুরু করেন: রিচার্ড ক্রুস্প, বেজিস্ট অলিভার রিডেল ও ড্রামার থেকে গায়ক হয়ে ওঠা টিল লিন্ডেমান। সহসাই এই আধা-গুরুত্ব দেওয়া সাইড-প্রজেক্টটি বাকি সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।
টিলের সঙ্গে ফ্লেকের প্রথম দেখা তার এই ভবিষ্যৎ ব্যান্ডমেটের পূর্ব জার্মানির বাসায় একটি গিগে। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে রাতের বেলা থাকতে দিতে রাজি কি না– এমন প্রশ্ন ফিলিং বি হরদমই করত। এক রাতে দর্শকসারিতে ছিলেন টিল। পাঁচটি বিছানা কিংবা এমনকি একটি ফ্লোর কেউ দিতে পারবে কি না, জানতে চাওয়া হলে তিনি ব্যান্ডটিকে নিজের বাড়িতে থাকার প্রস্তাব দেন। ‘আমরা সেখানে থাকলাম, এবং রীতিমতো পার্টি করলাম,’ বলেন ফ্লেক। ‘তারপর থেকে ওর বাড়িতে আমরা প্রায় নিয়মিতই যেতাম; আর এভাবে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল।’
মিউজিশিয়ান হওয়া আগে টিল ছিলেন একজন সাঁতার দানব। ফিলিং বির সঙ্গে সাক্ষাতের আগে শোয়েরিন-ভিত্তিক আর্ট-পাংক ব্যান্ড ফার্স্ট আর্শ-এ বাজাতেন তিনি। তাকে এক্সট্রা-কারিকুলাম জ্যাম সেশনগুলোতে সঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলো সহসাই, যে সেশনগুলোতেই বপন হয়েছিল রামস্টাইন-এর বীজ।
‘কোনো লক্ষ্য ছাড়াই, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই, স্রেফ টানা দুই ঘণ্টা ধরে বাজিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা একত্রিত হয়েছিলাম,’ স্মৃতিচারণায় বলেন ফ্লেক। ‘এটা কোনো ব্যান্ড ছিল না। এটা ছিল আমাদের জন্য একটা মিটিং পয়েন্ট; যেন আমাদের আসল ব্যান্ডগুলোর চেয়ে স্রেফ আলাদা কিছু করতে পারি। এটা ছিল একটা থেরাপি গ্রুপের মতো।’
এই নামহীন যৌথতার ভেতর দিয়ে লেখা প্রথম দিকের গানগুলোর একটির শিরোনাম ছিল রামস্টাইন শহরের নামে, সেখানে ১৯৮৮ সালে একটি এয়ারশো চলাকালে মাঝ আকাশে দুই বিমানের সংঘর্ষে প্রাণ গিয়েছিল ৭০ জনের। এই সাইড-প্রজেক্টের কথা যখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকল, তাদের পরিচিতি তখন হয়ে ওঠল ‘রামস্টাইন সং’য়ের ব্যান্ড হিসেবে।
“পরে লোকে বলতে থাকল, ‘এটা রামস্টাইন ব্যান্ড’, আর পরে এটি হয়ে উঠল রামস্টাইন।” সহসাই এই নামটি গ্রহণ করে নিলেন তারা, তবে ‘রাম’ শব্দের সঙ্গে একটি বাড়তি ‘এম’ অক্ষর জুড়ে নিয়ে। ‘রাম’ [Ramm] শব্দের ইংরেজি অনুবাদ ‘র্যাম’ [ram], মানে ‘ব্যাটারিং র্যাম’ [দেয়াল ভাঙার আদিমকালীন যন্ত্র], আর ‘স্টাইন’-এর [stein] ইংরেজি ‘ স্টোন’ [বা, পাথর]। “র্যাম- স্টোন”– তাদের সাউন্ডের সঙ্গে নিখুতভাবে মানিয়ে যাওয়া এক নাম।
প্রায় দেড় বছর রামস্টাইন এর সদস্যদের রেগুলার ব্যান্ডগুলোর পাশাপাশি এভাবেই টিকে ছিল। কখনো কখনো তারা ফিলিং বির সমান বিল নিয়ে বাজাত; উপার্জিত টাকা নিজেদের নতুন প্রজেক্টে বিনিয়োগ করত। রামস্টাইন যখন তাদের মূল ফোকাসে পরিণত হলো, তখন এ ব্যাপারটিতে কঠিন মনে হলো ফ্লেকের কাছে।
‘এটি কোনো পয়েন্ট ছিল না, এটি ছিল অনুভূতি,’ বলেন তিনি। ‘আমরা প্রচুর শো করেছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল, লোকে বিমুগ্ধ। আমরাও বিমুগ্ধ ছিলাম নিজেদের নিয়ে। মনে হয়েছিল, দারুণ এক ব্যান্ড হতে যাচ্ছে।’
…
‘শুরুতে
আমরা স্রেফ
আমাদের স্ট্রিট ক্লদ,
আমাদের আন্ডারওয়ার
পরে স্টেজে উঠে পড়তাম’
…
প্রথমদিকের সেই শোগুলোর বেশিরভাগই অনুষ্ঠিত হতো পুরনো পূর্ব জার্মানির ছোট্ট শহরগুলোতে, যেখানে ফিলিং বি তখনো জনপ্রিয়। রামস্টাইন-এর কিংবদন্তি লাইভ শো শুরুর তখনো বছর কয়েক বাকি অবশ্য। ‘শুরুতে আমরা স্রেফ আমাদের স্ট্রিট ক্লদ, আমাদের আন্ডারওয়ার পরে স্টেজে উঠে পড়তাম,’ বলেন ফ্লেক।
নববর্ষের ইভ পার্টির জন্য কিনে আনা ও মজুদ রাখা আতশবাজিগুলো ব্যবহার করে মঞ্চে পাইরোটেকনিক ডিসপ্লের প্রাথমিক প্রচেষ্টাগুলোর তখনই শুরু। ফ্লেক বলেন, “একবার আমরা সেগুলো শোতে নিয়ে গেলাম; মনে হলো, ‘দারুণ তো!’ তার পরেরবার আরেকটু বেশি করে নিয়ে গেলাম।”
তাদের পূর্ববর্তী ব্যান্ডগুলোর সদস্যদের পূর্ব জার্মানির দর্শক-শ্রোতারা চিনতেন এবং পছন্দ করতেন। অন্যদিকে, তাদের সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না পশ্চিম জার্মানির দর্শক-শ্রোতাদের; দেশের এই নতুন অভিগম্য পশ্চিমা অর্ধে তাদের শুরুর দিকের অল্প কিছু গিগ বিক্ষিপ্তভাবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘আমাদের শো দেখতে কেউই আসত না,’ পশ্চিমে নিজেদের আবেদন সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেন ফ্লেক।
নিজেদের প্রাক্তন স্বদেশের সঙ্গে ব্যান্ডটির সংযোগ ছিল স্রেফ দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা দিয়ে মাপার চেয়েও অনেক গভীরতর। শুরু থেকেই নিজের আঞ্চলিক উচ্চারণে গান গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন টিল। এর আংশিক কারণ, স্কুলে ইংরেজির চেয়ে বরং রুশ ভাষা শেখানো হয়েছিল তাদের সবাইকে।
‘খেয়াল করে দেখেছি, পূর্ব জার্মান ব্যান্ডগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই খুব বাজে রকমের ইংরেজিতে গান গায় এমন দর্শক-শ্রোতার উদ্দেশ্যে– যারা ইংরেজি বোঝেই না। এ একেবারেই ফালতু ব্যাপার,’ বলেন ফ্লেক। ‘অথচ আপনি যদি নিজের আবেগকে সত্যিকার অর্থেই প্রকাশ করতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই আপনার মাতৃভাষায় কথা বলতে হবে। অন্য কোনো ভাষায় নিজের আবেগ প্রকাশ করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না।’
পুনর্মিলন-উত্তর বার্লিনে স্কোয়াট কালচারের বিচ্ছুরণ ঘটেছিল। ফিলিং বির লিড ভোকাল আলয়োশার সঙ্গে ব্যান্ড ও আর্টিস্টরা শূন্য দালানকোঠা ও গুদামঘরগুলোকে ভরিয়ে তুলেছিল আধা-বৈধ কিংবা অবৈধভাবে। শহরটির পেঞ্জলাউয়ার বের্গ অঞ্চলের এমনই একটি দালানে ছিল একগুচ্ছ অ্যাপার্টমেন্ট, যেটি হয়ে উঠেছিল আলয়োশার নতুন রাজনৈতিক আন্দোলন– ‘ডি উইডকস’-এর [Die Wydoks] কেন্দ্রস্থল, এবং একইসঙ্গে একটি ফিল্ম স্টুডিও ও একটি পাইরেট রেডিও স্টেশন। এই দালানেই রামস্টাইন পরিবর্তিত আবহাওয়া ও সাম্প্রতিক অতীতের হ্যাংওভারে অনুপ্রাণিত তাদের প্রথম দিকের গানগুলোর রেকর্ডিং করে।
…
ভঙ্গিমাকে
হয়তো আমূল
সংস্কারবাদী বলা যায়,
তবে তাদের জার্নিটি ছিল
বিস্ময়কর রকমের গতানুগতিক
…
রামস্টাইন-এর ভঙ্গিমাকে হয়তো আমূল সংস্কারবাদী বলা যায়, তবে তাদের জার্নিটি ছিল বিস্ময়কর রকমের গতানুগতিক। ব্যান্ডটি এক প্রতিযোগিতায় একটি ডেমো টেপ জমা দেয়, যেটি স্টুডিও টাইমে জিতে নেয় প্রথম পুরস্কার। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তারা জিতে যায়, এবং তাদের পুরস্কারটি ব্যবহার করে একগুচ্ছ ডেমো রেকর্ড করে, যা জার্মান লেবেল ‘মোটর মিউজিক’-এর দৃষ্টি কাড়ে, এবং লেবেলটি এই ব্যান্ডকে একটি চুক্তির প্রস্তাব দেয়। স্টুডিওতে ঢোকার আগে অবশ্য একটি বাধা পার হতে হয় তাদের।
‘রেকর্ড কোম্পানিটি আমাদের বলেছিল, আমরা যেন নিজেরাই কোনো প্রডিউসার খুঁজে নিই,’ বলেন ফ্লেক। ‘প্রডিউসার কাকে বলে– জানা ছিল না আমাদের; কেননা, পূর্ব জার্মানিতে এমন কারও অস্তিত্ব ছিল না। সেখানে কিছু করার জন্য কোনো প্রডিউসারের দরকার ছিল না কারও।’
ব্যান্ডটিকে পরামর্শ দেওয়া হলো, যেন মিউজিক স্টোরগুলোতে ঘুরে ঘুরে, নিজেদের পছন্দের সিডিগুলোর পেছনে থাকা প্রডিউসারদের নামগুলো টুকে নেয়। তারা যখন লেবেল কোম্পানিকে জানাল, বব রক ও রিক রুবিনের সঙ্গে কাজ করতে চায়, তখন বিনয়ের সঙ্গে তাদের বলে দেওয়া হলো, তারা যেন নিজেদের উচ্চাভিলাষ একটু মেপে দেখে!
রামস্টাইন-এর প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম হের্জেলাইড-এর দেখভাল করেছিলেন সুইডিশ প্রডিউসার ইয়াকব হেলনার, যিনি নব্বইয়ের দশকের র্যাপ-মেটাল মিডেলওয়েটস ক্লফিঙ্গার-এর সঙ্গে কাজ করে বেশ খ্যাত। তাকে পাঠানো ডেমো ট্র্যাকগুলো তার মনে ধরেছিল, যদিও ব্যান্ডটির লাইভ পারফরম্যান্স দেখে তবেই সন্তুষ্ট হয়েছেন। একমাত্র শর্ত ছিল, রেকর্ড করার জন্য ব্যান্ডটিকে তার কাছে যেতে হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলেন ব্যান্ডমেটরা; ইয়াকবের নিজের রেকর্ডিং স্পেসে ওঠার আগে, ক্যাম্প গড়লেন স্টকহোমের পোলার স্টুডিওতে।
তাদের শুরুটা খুব একটা প্রসন্ন হয়নি। স্টুডিওটি ছিল সংকুচিত; আর, রিচার্ড যে ধরনের গিটার সাউন্ড চেয়েছিলেন, সে রকম বাজানো হয়ে পড়েছিল মুশকিল। একটা সমস্যাসংকুল সাংস্কৃতিক ঘূর্ণিজলে পড়ে গিয়ে রামস্টাইন বেশ নাখোশ হয়ে পড়েছিল। ‘ইয়াকব অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মঘণ্টা ধরে কাজ করেন,’ বলেন রিচার্ড। ‘ফলে সন্ধ্যাবেলা ও ছুটির দিনগুলোতে আমরা নিজেরা একলা পড়ে রইতাম। সুইডিশ ভাষায় কথা বলতাম না আমরা, ইংরেজিও খুব একটা না; নিজেদের খুবই বিচ্ছিন্ন লাগছিল। কোথাও যেতে পারতাম না, কিছুই করতে পারতাম না; ফলে আমাদের মন-মেজাজ খুব একটা ভালো ছিল না।’
ব্যান্ড শুধু জার্মান ও রুশ ভাষায় কথা বলে, আর প্রডিউসার কথা বলেন শুধু ইংরেজি ও সুইডিশ ভাষায়; ফলে বিশেষ রকমের জটিলতা তৈরি হলো। কাজ যত এগোতে লাগল, কমিউনিকেশনের ইস্যুটা তত স্পষ্ট হয়ে ওঠল। ইয়াকব যেভাবে মিউজিক করাচ্ছিলেন, তাতে ব্যান্ডটি ছিল নাখোশ; অথচ কথা বলার মধ্য দিয়ে এর কোনো সুরাহা করা যাচ্ছিল না ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে।
ইয়াকব একটা সমাধান খুঁজে নিলেন। জানালেন, উভয় পক্ষের ভাষাই জানা আছে– বাইরে থেকে এমন একজনকে নিয়ে আসবেন। যে লোক সেই দায়িত্ব পালন করে অ্যালবামটিকে বাঁচিয়েছিলেন, তিনি ডাচ ইঞ্জিনিয়ার রোনাল্ড প্রেন্ট।
“‘বাঁচানো’ শব্দটার তাৎপর্য অনেক বড়,” মেটাল হ্যামারকে বলেন রোনাল্ড। ‘এটা তো খুঁইয়ে ফেলার ঘটনা ছিল না, তবে তারা যেভাবে চেয়েছিলেন, সেটি পারছিলেন না। মিউজিকের ভেতর দিয়েই আমাদের সাক্ষাৎ ও পথচলা এগিয়েছে। (ব্যান্ডের) লোকগুলোর মাথায় কী চলছে এবং ইয়াকব হেলনারের মাথায়ই-বা চলছে কী, দুই পক্ষ আসলে কী চাচ্ছে– আমি তা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।’
প্রথম গানটি গড়ে তুলতে বেশ দীর্ঘ ও কখনো কখনো পরিপূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। রামস্টাইন কাজ করেছে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়: ব্যান্ডমেম্বাররা কী খাবেন থেকে শুরু করে কোন গানের সাউন্ড কী রকম শোনাবে পর্যন্ত সব সিদ্ধান্ত ছয় সদস্যের প্রত্যেকেই একমতে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে নেওয়া হয়েছে।

‘আমরা যা করেছি, তা তারা আমাদের করতে দিয়েছেন,’ বলেন রোনাল্ড, যিনি ইয়াকবের হয়ে কাজ করেছেন, ‘আর, যখন মনে হয়েছে, এর কোনো অন্যতর ভার্সন রয়েছে আমাদের কাছে, যেমনটা করতে পারলে দারুণ হবে, তখন ব্যান্ডকে তাতে যুক্ত করেছি। তারা সেটা শুনেছেন, এবং তারপর ডেকেছেন সেই সভা, যেটাকে পরবর্তীকালে আমরা তাদের বিখ্যাত ‘জার্মান কনফারেন্স’ বলে ডাকি– তারা স্টুডিও থেকে বের হয়ে, লিভিং এরিয়ার একটি রুমে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ সেরেছেন। কখনো কখনো সেই আলাপের ব্যাপ্তি ছিল ১০ মিনিট, কখনো-বা ২ ঘণ্টা– যতক্ষণ না কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছেন। তারপর ফিরে এসে বলতেন, ‘জিনিসটা আসলেই দারুণ, কিন্তু রামস্টাইন ধরনের না; আমরা কি অন্যকিছু করতে পারি?’”
বহুস্তরি মিক্সিং, বিকল্প লেভেল, গিটারের শেপিং এবং ভোকালের ভলিউম বাড়ানো ও কমানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন তারা। সব মিলিয়ে সে এক কমেডির মুহূর্ত! “একবার হয়তো কেউ একজন বললেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের বন জোভির মতো সাউন্ড বানানো দরকার। আমরা কি তা পারব?’ আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’ এ ছিল ভয়াবহ রকমের গুরুতর ব্যাপার। ফলে আমরা ট্র্যাকটির মিক্সিং বন জোভির মতো করলাম। আর রেজাল্ট সত্যি কাছাকাছি রকমের দাঁড়াল। তারা এসে শুনে বললেন, ‘আরে, দারুণ তো! আমরা সত্যি বন জোভির মতো সাউন্ড বানিয়েছি; কিন্তু এটা তো আমাদের সাউন্ড না!’”
রিচার্ড পরে বলেছেন, এই প্রক্রিয়া আসলে ব্যান্ড ও রোনাল্ডের মধ্যে চাপা উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছিল; তবে এ প্রসঙ্গে রোনাল্ডের দৃষ্টিকোণ অবশ্য ভিন্ন। ‘কখনো কখনো স্টুডিওতে থাকাটা অনেকটা ছোটখাট কমিউনিটিতে থাকার মতো, যেখানে আপনাকে দিনে ১২ ঘণ্টার জন্য অন্যদের সঙ্গে আটকা থাকতে হবে,’ বলেন তিনি।
“আপনি গাধার মতো খেটে যাবেন, আর কেউ এসে বলে দেবে, ‘হ্যাঁ, দারুণ কাজ, কিন্তু আমাদের জন্য নয়।’ আপনি হতাশ হয়ে যাবেন। আমি এমন কথা হয়তো বলতে পারতাম, ‘তোমরা হয়তো এটাতে আরেকটু বেশি কিছু চাও, তোমরা বোধহয় এটাকে বাতিল করার আগে আরেকটু সময় দিতে চাইবে।’”
রোনাল্ডের মতে, প্রথম গানটিকে ঠিকঠাক রূপে পাওয়ার জন্য সময় লেগে গিয়েছিল সাত দিন। তবে যখনই সেটা চূড়ান্ত হয়ে গেল, তারপর রেকর্ডিং এগিয়ে নিতে আর সমস্যা হয়নি। অ্যালবামের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এর সৃষ্টিকালে ঘটা সকল বিরোধ স্পষ্টতই সবাই ভুলে গেছেন। নিজেদের দ্বিতীয় অ্যালবাম জিনজোখ্ট্ সৃষ্টির সময় রোনাল্ডকে নিজেদের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিল ব্যান্ডটি।
‘রামস্টাইন-এর প্রথম দুটি অ্যালবামের সাউন্ড আমারই সৃষ্টি,’ বলেন রোনাল্ড, ‘কথাটা বলা আমার পক্ষে কঠিন; তবে এ আমারই কাজ।’
রামস্টাইন-এর অভিষেক অ্যালবাম জার্মানিতে মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। এর শিরোনাম হের্জেলাইডকে ইংরেজিতে হরদম ‘হার্টব্রোকেন’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়। এ অ্যালবাম সৃষ্টিকালের সময় এর একাধিক সদস্য যে ধরনের রোমান্টিক সমস্যার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন, সেই উল্লেখ টেনেই এমন অনুবাদ।
‘প্রেমিকার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল আমার; খুবই কঠিন সময় ছিল সেটি,’ রিচার্ডের স্মৃতিচারণা। ‘এর আগে কখনোই এমন তীব্র কোনো আবেগাত্মক অভিজ্ঞতা আমার হয়নি। একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আপনি যদি নিজে এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে না যান, তাহলে আমার সেই অনুভূতিকে উপলব্ধি করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না।’
…
‘রামস্টাইন
হয়ে ওঠার পেছনে
এইসব ব্যক্তিগত সমস্যায়
ভোগান্তিরও ভূমিকা রয়েছে’
…
‘টিলও একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। যেহেতু সে ছিল আমার ভালো বন্ধু, তাই আমি মাসকয়েক ওর সঙ্গে ছিলাম। আমার ধারণা, এভাবেই আমরা পরস্পরকে সাহায্য করেছি। আসলে, রামস্টাইন হয়ে ওঠার পেছনে এইসব ব্যক্তিগত সমস্যায় ভোগান্তিরও ভূমিকা রয়েছে।’
তাদের মানসিকতার সেই সম্মিলিত অবস্থা আসলে হের্জেলাইড-এর অগ্রযাত্রায় কাজে লাগেনি! ‘প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করার পর (বলার মতো) কিছুই ঘটেনি,’ বলেন ফ্লেক। ‘কেউ এটা কিনতে চায়নি; কারণ, এর কথা জানত না কেউ। আমরা স্রেফ একের পর এক পারফর্ম করে গেছি; আর ধীরে ধীরে দর্শক-শ্রোতা বাড়তে থেকেছে।’
যে সুইডিশ ব্যান্ডের অ্যালবাম প্রডিউস করেছেন ইয়াকব হেলনার, সেই ক্লফিঙ্গার-এর গায়ক জাক টেলের অবশ্য রামস্টাইনকে পছন্দ করেছিলেন। ১৯৯৫ সালের শেষ ও ১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শো’তে জার্মান ব্যান্ডটিকে সাপোর্ট যোগায় ক্লফিঙ্গার।
‘তারা সেটা চেয়েছিল। ব্যাপারটা সহজ,’ বলেন জাক, “ওদেরকে আমরা একেবারেই শুরু থেকেই চিনতাম। মিলিটারি ইউনিফর্ম করে জার্মান ভাষায় গান গেছে নিজেদের ‘আর’-এর গর্জন ছড়াচ্ছে– এমন ব্যান্ডটির কথা জানতাম। তারা আবার ফ্যাসিবাদী কিংবা নাৎসি নির্বোধে পরিণত হয় কি না, এই উৎকণ্ঠা ছিল আমাদের। ফলে জার্মান ভাষা জানে, এমন এক বন্ধুর শরণাপন্ন হলাম। সে আমাদেরকে ওদের লিরিকগুলো অনুবাদ করে শোনাল। আর তখনই ওদের কাজকর্ম নিয়ে সন্তুষ্টি পেলাম।”
১৯৯৬ সালের মধ্যভাগে রামস্টাইন নিজেদের ট্যুরের কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়ে ওঠল। ভেন্যুগুলো ছোট ছিল, তবে সব টিকেট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল; তাই বৃহত্তর দর্শক-শ্রোতার কাছে আরও বেশি মনোযোগ পেতে শুরু করেছে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড– এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ল। এটি মঞ্চে ব্যান্ডটির বিস্ময়বিমুগ্ধকর ভিজুয়াল ইমেজ সৃষ্টি করতে সাহায্য করল। স্ট্রিট ক্লদ পরে ছয়টা লোকের পারফর্ম করার দিন এলো ফুরিয়ে। আক্ষরিক অর্থেই আগুনের বিচ্ছুরণ ঘটানোর ঝোঁকও ক্রমাগত বাড়তে থাকল।
‘মঞ্চে প্রচুর ফায়ারওয়ার্ক করেছে ওরা, এমনকি আগুনও ধরিয়ে দিয়েছে,’ স্মৃতিচারণায় বলেন ১৯৯৬ সালে বেশ কিছু কনসার্টে রামস্টাইনকে সাপোর্ট দেওয়া স্টাটগার্টের [জার্মানি] গ্রুভ-মেটাল ব্যান্ড ফারমার বয়েজ-এর গায়ক ম্যাথিয়াস সায়ার।

‘হাতে দস্তানা পরত টিল, সেখান থেকেও স্ফুলিঙ্গ বের হতো। সে সময়ে এমনকিছু করার আনুষ্ঠানিক অনুমতি তাদের ছিল কি না, এ ব্যাপারে আমি অবশ্য নিশ্চিত নই। এমন কিছু করতে হলে অনুমতি নেওয়াই লাগত; আর রামস্টাইন ধীরে ধীরে সেইসব বিধিবিধান একাকার করে ফেলার সুযোগ করে দিয়েছিল। তবে দেখতে দারুণ লাগত। ওরা জানত, ওরা কী করছে; আর প্রত্যেকের মনে ওরা আসলেই একটা ছাপ ফেলতে পেরেছিল।’
অনেকটাই নতুন ধরনের উপস্থিতিসত্তা ও সাউন্ডের সমাহারে প্রাক্তন পূর্ব জার্মানির এই বিস্ময়কর ব্যান্ডটির প্রতি নজর দিতে শুরু করেছিল মূল ইউরোপ। তবে ওদের ইস্টার্ন ব্লক ব্যাকগ্রাউন্ড তখনো পুনর্মিলিত জার্মানিতে সাংস্কৃতিক সংঘাতের একটা মাত্রা জারি রেখেছিল।
‘ওরা ছিল আমাদের চেয়ে ১০ বছরের বড়, এবং ওরা সমগ্র পূর্ব জার্মান সিস্টেমের ভেতর দিয়ে গিয়েছে; ফলে ওদের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন ছিল আমাদের জন্য। কেননা, আমাদের অভ্যস্ত অভিজ্ঞতার চেয়ে তা ছিল একেবারেই ভিন্ন,’ বলেন ম্যাথিয়াস। ‘এটা কোনো নেতিবাচক দিক নয় আসলে; স্রেফ আমাদের জন্য খানিকটা বেমানান ছিল– এই যা। আমাদের মধ্যে মিল ছিল খুবই সামান্য, যদিও আমরা উভয় ব্যান্ডই জার্মান।’
রামস্টাইন-এর ছয় সদস্য স্বীকার করেন, রামস্টাইনকে উপলব্ধি করা প্রচুর মানুষের পক্ষেই ছিল বিরাট মুশকিলের ব্যাপার। তবে এই প্রবঞ্চনাময় হেঁয়ালিপূর্ণ ও হরদম ভুল বোঝাবুঝির শিকার ব্যান্ডটির সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশির ভাগ জিনিসের মতোই তাদের করা সব কর্মকাণ্ডের মধ্যে উন্মাদনার একটি পদ্ধতি ছিল।
…
রামস্টাইন-এ
আমরা সব ধরনের
সেন্সরশিপকে উড়িয়ে
দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলাম–
সেটি অন্যদের চাপিয়ে দেওয়া
তো বটেই, নিজেদের
অন্তস্থলে থাকা
সেন্সরশিপও
…
‘এই কারণেই রামস্টাইন ছিল ভীষণ প্রোগ্রেসিভ– যেখানে সে সময়ে অনেক বেশি সেন্সরশিপের উপস্থিতি আমরা অনুভব করেছি,’ বলেন রিচার্ড। “রামস্টাইন-এ আমরা সব ধরনের সেন্সরশিপকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলাম– সেটি অন্যদের চাপিয়ে দেওয়া তো বটেই, নিজেদের অন্তস্থলে থাকা সেন্সরশিপও। আমার ধারণা, এ কারণেই আমাদের প্রত্যেকের মনোভাব ছিল– ‘বালের আলাপ, চুদি না আমরা!’”
এই একক-মানসিকতার দাম সম্ভবত ব্যান্ডটি পেয়েছে বছর কয়েক পরেই, যখন কাল্ট ফিল্মমেকার ডেভিড লিঞ্চ তার ১৯৯৭ সালের আর্টহাউস সিনেমা লস্ট হাইওয়ের সাউন্ডট্র্যাকে এই ব্যান্ডকে জায়গা করে দিয়েছেন। এরপর হুট করেই স্ফুলিঙ্গ-বিচ্ছুরিত জ্যাকেট পরা ও হাস্যকর উচ্চারণে গান করা এই পাগলাটে জার্মান ব্যান্ডের সামনে একটি একেবারেই নতুন দর্শক-শ্রোতার দুনিয়া খুলে যায়। সেই একই বছর মুক্তি পায় তাদের মাস্টারফুল দ্বিতীয় অ্যালবাম জিনজোখ্ট্; সেটি তাদেরকে মূল ইউরোপের তারকাদের মাঝে জায়গা করে দেয়, এবং আগে মুক্তি পাওয়া প্রথম অ্যালবামকেও টেনে আনে পাদপ্রদীপের নিচে।
‘আমাদের দ্বিতীয় অ্যালবামের পর লোকে প্রথম অ্যালবামের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে,’ বলেন ফ্লেক। ‘জিনজোখ্ট্-এর মাধ্যমে আমরা গোল্ড রেকর্ডের অধিকারী হয়েছিলাম; আর পাঁচ বছর পর প্রথম অ্যালবামটিও পায় গোল্ডের মর্যাদা।’

এর বছর কয়েক পর, একগুচ্ছ ‘বিপজ্জনক’ সাজে সজ্জিত রামস্টাইন মঞ্চ থেকেই গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে, ১৯৯৯ সালের কলম্বাইন স্কুল ম্যাসাকারের প্রতিবাদে জাগরণের কালে একটি ভুলবার্তাবাহী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নাৎসিবাদের প্রতি পথভ্রষ্ট হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়।
আজকের দিনে তারা গত দুই দশকের মধ্যে রক মিউজিকে সবচেয়ে সফল কাহিনির রচয়িতাদের একটি হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এবং নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ‘অসম্ভব’ ব্যান্ডেরও একটি। তাদের যা কর্মকাণ্ড, তা আগে ভাবেনি কেউ কখনো। বিশেষ করে বার্লিন দেয়ালের অপর পাশ থেকে আসা এই ছয় মিসফিট বা ‘বেমানান’ লোকের ক্ষেত্রে– যারা কাটিয়ে দিয়েছে ২৫ বছরেরও বেশি সময়, এবং সম্ভাব্য সকল ট্রেন্ডের প্রতিই জানাচ্ছে দাপুটে সাড়া।
‘আমাদের পক্ষে কখনোই ওয়েস্টার্ন ব্যান্ড হওয়া সম্ভব নয়,’ বলেন ফ্লেক, ‘কেননা, যৌবনেই আমরা শিখে গিয়েছিলাম, একজন ব্যক্তিমানুষের গুরুত্ব ততটা নেই, বরং একসঙ্গে কাজ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই এখনো আমরা একসঙ্গে রয়েছি।’
ডেভ এভারলি: সিনিয়র প্রিন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল মিউজিক এডিটর; লন্ডন, ইংল্যান্ড
সূত্র: মেটাল হ্যামার; মাসিক হেভি মেটাল ও রক মিউজিক ম্যাগাজিন; যুক্তরাজ্য। ৪ জুলাই ২০১৯

লাইনআপ [১৯৯৪–বর্তমান]
টিল লিন্ডেমান [লিড ভোকাল, হারমোনিকা]
রিচার্ড ক্রুস্প [লিড গিটার, ব্যাকিং ভোকাল]
পল ল্যান্ডার্স [রিদম গিটার, ব্যাকিং ভোকাল]
অলিভার রিডেল [বেস গিটার]
ক্রিস্টোফ স্নাইডার [ড্রামস, পারকাশন]
ক্রিশ্চিয়ান ‘ফ্লেক’ লরেঞ্জ [কীবোর্ডস, স্যাম্পলস, সিন্থেসাইজার, ট্রাম্পেট, প্রোগ্রামিং]

স্টুডিও অ্যালবাম
হের্জেলাইড [Herzeleid; ১৯৯৫]
জিনজোখ্ট্ [Sehnsucht; ১৯৯৭]
মুটার [Mutter; ২০০১]
রেইজ, রেইজ [Reise, Reise; ২০০৪]
রোজেনরট [Rosenrot; ২০০৫]
লিবা ইস্ট ফুর আলা ডা [Liebe ist für alle da; ২০০৯]
আনটাইটেলড [Untitled Rammstein album; ২০১৯]
জাইট [Zeit; ২০২২]*