সাক্ষাৎকার: রুদ্র আরিফ
জিয়াউর রহমান। জিয়া নামেই বেশি খ্যাত। তুমুল জনপ্রিয় রক গ্রুপ ‘শিরোনামহীন’-এর প্রতিষ্ঠাতা, ব্যান্ড লিডার ও বেজিস্ট। ব্যান্ডটির বেশির ভাগ জনপ্রিয় গানের কথা ও সুর তারই। ‘শিরোনামহীন’কে ঘিরে ‘লালগান’-এর পক্ষে তার সঙ্গে দীর্ঘ এ আলাপটি হয় ৭ জুলাই ২০২১, ঢাকায় তার বাসায়। শ্রুতিলিখনজনিত বিড়ম্বনায় প্রকাশে খানিকটা বিলম্ব হলো। দীর্ঘ এ আলাপটি কয়েক কিস্তিতে প্রকাশ করা হবে। এখানে রইল প্রথম কিস্তি…

রুদ্র আরিফ :: শুরুতেই আপনাদের প্রস্তুতিপর্বের কথা জানতে চাই…
জিয়াউর রহমান :: আমি তখন স্কুলে পড়ি। সেটি ছিল সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল। তখন ক্লাস নাইন-টেনের দিকে। মিউজিক শোনার একটা প্রবণতা ছিল। পছন্দ করতাম শুনতে। অই জায়গা থেকেই এক ধরনের আগ্রহ জন্মায় যে, মিউজিকটা নিজেও করতে চাই। তখন গিটার শেখা স্টার্ট করি।
কলেজে যখন উঠি, নটরডেম কলেজ ছিল, অই সময়টায় মোটামুটি যেইটুকু পারি (চেষ্টা করছি)। কিছু বন্ধু ছিল, তারাও মিউজিক করছিল, বা চেষ্টা করছিল, শিখতেছিল (আমরা একসঙ্গে জড়ো হলাম)। আমি গিটার ধরেছিলাম নাইনটিতে, আর কলেজে পড়েছি নাইনটি টু-থ্রি। অই টাইমটাতেই আমরা যারা একত্রে মিউজিক শুনতাম বা একত্রে মিউজিক শেখার চেষ্টা করতেছি, তারা আসলে একটা ব্যান্ড করলাম। মানে তখন তো আমাদের দেশে আসলে আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক– এই নোশনটাই ছিল না, বাট উই স্টার্টেট… কাইন্ড অফ। ব্যাপারটা এ রকমই।
মানে, আমরা যেই ধারায় মিউজিকটা করতাম, সেটার জন্য আমাদের দেশ তখনো প্রস্তুত ছিল না। আমাদের লিসেনাররা প্রস্তুত (ছিল) না। অই সময়টায় আমি কিছু কনসার্ট অর্গানাইজও করার চেষ্টা করি। সেগুলোই হচ্ছে বাংলাদেশে প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড কনসার্ট। সো, উই পারফর্ম দেয়ার, এবং অই কালচারটা স্টার্ট হয়, যেটা পরবর্তীকালে অনেকদূর ক্যারি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এই আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিক বড় হচ্ছে এবং আরও অনেক ওয়ানাবি মিউজিশিয়ানস যারা শিখছে, তারাও এটার মধ্যে ইনক্লুড হচ্ছে। এ জায়গাটা আসলে এক ধরনের ভালোলাগা তৈরি করে।
সো, মিউজিকের প্রস্তুতি বলতে আসলে এইটাই। এরপরে মেইনস্ট্রিম মিউজিকে চলে আসি এবং নাইনটি সিক্সে আমি শিরোনামহীন ফাউন্ড করি।

রুদ্র :: প্রথম নামটা কী ছিল, যখন আন্ডারগ্রাউন্ড শুরু করলেন?
জিয়া :: প্রথম… যখন আন্ডারগ্রাউন্ড করতাম, অইটা একটা ডিফারেন্ট ব্যান্ড। অই ব্যান্ডটা স্টাবলিশ করেছিলাম। অই ব্যান্ডটার নাম ছিল থ্র্যাশহোল্ড। সো, থ্র্যাশ মেটালই প্র্যাকটিস করা হতো। আমরা মূলত কাভার করতাম মেটালিকা, মেগাডেথ, প্যানটেরা… এগুলো। এর বাইরেও তিনটা গান তৈরি করা হয়েছিল…
রুদ্র :: …বাংলায়?
জিয়া :: …ইংরেজিতে। যার মাঝে পরবর্তীকালে একটা গানকে বাংলায় ট্রান্সফার করে আমি আরেকবার নিয়ে আসি। তিনটা গানই আমার লেখা, আমার সুর করা ছিল। সো…
রুদ্র:: আমি একটু ইন্টারাপ্ট করি… বাংলায় ট্রান্সফার বা ট্রান্সলেট করলেন, ওইটা কোন গানটা?
জিয়া :: অই গানটার নাম ছিল প্রমিজ। বাংলায় যখন ট্রান্সফার করি, সেটা সবাই যেই নামে চিনে, সেটা হচ্ছে পাখি। এক্সেক্টলি এই গানটাই অনেক আগে ইংরেজিতে করা ছিল। আমাদের শিরোনামহীন-এর জাহাজী অ্যালবামের মোটামুটি গল্পটা এ ধরনেরই।
জাহাজী আমরা রিলিজ করি টু থাউজেন্ড ফোরে, ব্যান্ডটা স্টার্ট হয়েছে নাইনটি সিক্সে। এই সময়টার জার্নি, বা এরও আগে যে ধরনের গান তৈরি করার চেষ্টা করতাম, সেখান থেকে আসলে যে গানগুলো তৈরি করেছিলাম, তার মাঝে থেকে সিলেক্টেড একটা কম্পাইলেশনের নাম হচ্ছে জাহাজী। এমন নয় যে ২০০৪ সালে বা ২০০৩ সালে তৈরি করে সেটা রিলিজ করা হয়েছে। না।
যেমন, এখানে একটা সার্টেইন (ব্যাপার) আছে, যে, ‘স্টার সার্চ টু থাউজেন্ড’– বেনসন অ্যান্ড হেজেসের– অই সময়টায় আমাদের দেশে এই টেলেন্ট হান্টটা হয়েছিল ‘স্টার সার্চ’ নামে। দ্যাট ওয়াজ রিয়েলি, রিয়েলি… মানে অনেক এফেক্টিভ। পরবর্তীকালে আসলে অনেক রকমের টেলেন্ট হান্টই আমি দেখলাম, এবং অনেক টেলেন্ট হান্টের জন্যে জাজ হিসেবেও গেছি, কিন্তু ওরা যেভাবে করেছিল বা যে আঙ্গিকে এই প্রচেষ্টাটা করতে হয়, সেটা আসলে বেনসন অ্যান্ড হেজেসই দেখিয়েছিল আমাদেরকে এবং তারা পেরেছিল; আমার মনে হয়, বাকি সবাই আসলে ফেইল করেছে।
রুদ্র :: অইটাও বোধহয় দুই-তিন সিজনের বেশি (চলেনি)…
জিয়া :: অইটা তিন সিজন বা চার সিজন চলেছে। আমরা ছিলাম সেকেন্ড সিজনের লোক। ফার্স্ট সিজনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভাইকিংস, সেকেন্ড সিজনে আমরা ফাইনালিস্ট ছিলাম, বাংলা নামে আরেকটা ব্যান্ড ফাইনালিস্ট ছিল; এবং ফাইনালে যেতে পারেনি, কিন্তু অডিশন রাউন্ড পর্যন্ত ছিল আর্টসেল।
এইজন্য এইটা বললাম: ওদের প্রচেষ্টাটা কী ছিল, বা কতটুকু ইফেক্টিভ, সেটা এই গল্প থেকে বোঝা যায়। মানে, প্রত্যেকটা ব্যান্ড– যারা অই প্ল্যাটফর্মে গিয়েছিল, তারা প্রতেক্যেই এরপরে রুল করেছে আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। অন্য কোনো টেলেন্ট হান্ট থেকে আমরা এইটা পাই নাই, যে, হ্যাঁ, অই টেলেন্ট হান্টের চ্যাম্পিয়ন অনেক ভালো করেছে বা আমাদের মিউজিকে অনেক কন্ট্রিবিউট করেছে, বা অই টেলেন্ট হান্টের একজন রানারআপ বা ফাইনালিস্ট সে একটা কিছু পরবর্তীকালে কন্ট্রিবিউট করতে পেরেছে। না, পারে নাই। দেখা যায়নি; মানে ওভাবে আর এক্সিস্ট করতে পারেনি।
দ্যাটস হোয়াই আমার মনে হয়েছে, ওরা যেভাবে পরিচালনা করেছিল, টেলেন্ট হান্ট আসলে শ্যুড বি গাইডেড লাইক দিস, যেটা অনেক প্রপার ছিল, যেটা আসলে আমাদের জন্য… আমাদের মিউজিককে কন্ট্রিবিউট করতে পেরেছে। সো অন দ্যাট নোট, অই সময়টায় আমাদের, যেটা নাইনটি সিক্সের গল্প করতেছিলাম, নাইনটি সিক্সে আমরা তিন বন্ধু, অ্যাকচুয়ালি দুই বন্ধু আরেকজনকে খুঁজে বের করে আনি; এই তিনজনে মিলে ব্যান্ডটাকে স্টার্ট করি।
[জিয়া ভাইয়ের ফোন এলো। কিঞ্চিৎ বিরতি…]
…যেটা বলছিলাম, তিন বন্ধু… আমি আর আমার এক বন্ধু, ওই বন্ধুর নাম জুয়েল, ও আমাদের জাহাজী লাইনআপ পর্যন্ত ছিল, ইচ্ছেঘুড়ির সময় থেকে সে আর নেই। তো, ও শুরু থেকেই ছিল। আমরা ব্যান্ডটা স্টার্ট করলাম। আমরা একটা ভোকালকে খুঁজে বের করলাম। ভোকালের নাম বুলবুল ভাই। ছায়ানটে উনি গান শিখেছিলেন নজরুল সংগীত বিভাগে এবং উনি গান শিখাতেন, গানের টিচার ছিলেন। থাকে না, ছোট বাচ্চাদের গান শেখানো? অই ধরনের। উনি টিচার ছিলেন। খুব ভালো গাইতেন। সো, উই স্টার্ট।
…
আমাদের দেশে মিউজিকে
অনেক ভালো যারা
করে, বা যারা
সর্বোচ্চ
পর্যায়ে
যায়,
তাদেরও
ফিন্যান্সিয়াল
সিকিউরিটি বলতে কিচ্ছু থাকে না
…
২০০০ সালে এই লাইনআপে একটু একটু করে চেঞ্জ হয়। কারণ আমাদের দেশের বাস্তবতা হচ্ছে যে মিউজিককে আসলে প্রফেশনালি নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয় না; যাদের তৈরি হয়, তারাও দেখা যায় যে একটা টাইমে গিয়ে সেটার জন্য সাফারই করে। যেমন, দেশে একজন সবচেয়ে বড় রকস্টার হচ্ছেন আজম খান। আজম খানও কিন্তু আসলে ফিন্যান্সিয়ালি ভিকটিমাইজডই হয়েছেন। তার মানে, আমাদের দেশে মিউজিকে অনেক ভালো যারা করে, বা যারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে যায়, তাদেরও ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটি বলতে কিচ্ছু থাকে না।
লেট অ্যালোন আদারস। যারা ওয়ানাবি, যারা লার্নিং– তাদের কথা আমি বলছিই না; তাদের অনেক স্ট্রাগল। আমাদেরকে সেই স্ট্রাগলটা করতে হয়েছিল, যখন আমরা (নতুন) ছিলাম। স্ট্রাগল করে পরবর্তীকালে অ্যাচিভমেন্ট এলেও, অ্যাচিভমেন্ট আসাটা খুব সহজ না; খুবই কঠিন। সেটা এলেও তার ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটি থাকে না। এই হচ্ছে আমাদের দেশ!
দ্যাটস হোয়াই বুলবুল ভাই ক্যুড নট কন্টিনিউ। অই জায়গাগুলা চেঞ্জ হয়েছিল। জুয়েল ছিল। আমি ছিলাম। আমরা বেনসন অ্যান্ড হেজেসে যখন কমপিট করি, অই সময়ে আমাদের ভোকাল ছিল মহীন দেওয়ান।
মহীন মূলত নাট্যচর্চার সাথে জড়িত ছিল। থিয়েটারকর্মী। মিরপুরের একটা থিয়েটার গ্রুপ অনেক আগে থেকে স্ট্রাগল করেছে অনেক বড়– যেটাকে বলা হয় থিয়েটার ফাইট– থিয়েটার যোদ্ধা আরকি সে। অই গ্রুপটার নাম হচ্ছে ‘সাত্ত্বিক নাট্য সম্প্রদায়’। এর একদম প্রধান দু’তিনজনের একজনই মহীন।
সে ভালো গাইত। সে আমাদের সাথে জয়েন করল। আমরা কমপিট করলাম এবং ফাইনালে গেলাম। অই সময় আমার মনে হয় জাহাজী অ্যালবামে যে গানগুলো, এগুলো থেকেই গেয়েছিলাম; এ ছাড়া কাটাতাঁর নামে একটা গান ছিল, যেটা আমরা করেছিলাম। জাহাজী ছিল, শুভ্র রঙিন, শহরের কথা… (এগুলোর কথা) আমার মনে আছে। এগুলো ছোট ছোট রেকর্ড করে ক্লিপ আকারে আমাদের জমা দিতে হয়েছিল। দ্যাট ওয়াজ আওয়ার ফার্স্ট রেকর্ডিং ফর শিরোনামহীন, যেখানে ভোকাল মহীন।
ওগুলো জমা দেওয়ার পর আমরা সিলেক্টেড হলাম। আমার মনে আছে, যেদিন আমাদের অডিশন হয়, অডিশনটা একটা স্টুডিওতে হয়েছিল, আমরা খুব ফরচুনেট যে, আমরা ছিলাম অডিশনের একদম লাস্ট ব্যান্ড। সবার অডিশন হয়ে গেছে, শুধু আমরা আছি। আমাদেরটা শেষ হলে জুরাররা যার যার মতো বাছাইতে চলে যেতে পারবে। ফুয়াদ নাসের বাবু ভাই ছিলেন জুরার; পার্থদা ছিলেন, জেমস ভাই ছিলেন, বাচ্চু ভাই ছিলেন, আজম খান ছিলেন, বগি ভাই ছিলেন… ওনারা সবাই জুরার ছিলেন।
…
আমরা
ছিলাম একটু
দুর্বল টাইপের এবং
তখন শিরোনামহীন-এর
চেহারাটা ছিল একদমই
অ্যাকুয়েস্টিকধর্মী
একটা
ব্যান্ড
…
ফুয়াদ নাসের বাবু ভাই আমাদের জুরার হিসেবে অই অডিশনে বসলেন… আমাদের স্পেসিফিক হিসেবে। আমার অতটা মনে নাই, ইফ আই অ্যাম নট রং, ঠিক আমাদের সময়টায় ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আমরা তো পারফর্ম করতে পারতেছি না। আমাদের না (তাতে) খুব সুবিধা হয়েছে! ইনফ্যাক্ট, আমরা ছিলাম একটু দুর্বল টাইপের এবং তখন শিরোনামহীন-এর চেহারাটা ছিল একদমই অ্যাকুয়েস্টিকধর্মী একটা ব্যান্ড। গিটার বাজাতাম। তার সাথে আমাদের যে রিদম সেকশনটা, সেটাও ছিল অ্যাকুয়েস্টিক সেকশন। নট লাইক ড্রামস অ্যান্ড বাস সাউন্ড; না। যেটা আমরা এখন, তখন আমরা এ রকম ছিলাম না।
আমি বললাম, ‘বাবু ভাই, উই ক্যান গিভ দ্য অডিশন। কারণ, আমাদের ইলেকট্রিসিটি লাগবে না।’
বাবু ভাই বললেন, ‘কেন, কেন? কী ব্যাপার?’
বললাম, ‘আমাদের কোনো কীবোর্ড নাই এবং আমাদের যন্ত্র সব অ্যাকুয়েস্টিক। সো, আমরা এভাবেও শোনাতে পারব। সেটাতে আমরা অভ্যস্ত।’
তিনি বললেন, ‘ওকে, তাইলে তোমরা কী পারফর্ম করবা?’
আমি বললাম, ‘আমরা মূলত ক্যাম্পাসে গান গেয়ে বেড়াই। সেটা মূলত চেয়ার টেবিল চাপড়ে করে থাকি।’
বললেন, ‘ওকে।’
অই সময় যেহেতু ইলেকট্রিসিটি নাই, লাইট-টাইট সব বন্ধ হয়ে গেছে, মোমবাতি জ্বলছে… যেটা অ্যামাজিং… আমরা যে অডিশনের জন্য গানগুলা গাইলাম, সব অ্যাকুয়েস্টিক গিটার দিয়ে, অ্যাকুয়েস্টিক পারফরম্যান্সে, মোমের আলোয় ওই গানগুলো অসাধারণ লাগছিল। এটা আমি এখন বুঝতে পারি, যখন নিজে আরও দশটা প্রোগ্রামের জন্য জুরার হিসেবে বসেছি; আমার মনে হয়েছে, হ্যাঁ, এ রকম কোনো ঘটনা যদি কোনো ব্যান্ডের ক্ষেত্রে আমার সামনে ঘটত, খুবই ইমপ্রেশড হতাম। ওইটা আমাদের খুবই হেল্প করেছিল।
আমার মনে হয় একদম প্রপার, সবাই যেভাবে অডিশন দিচ্ছিল– অইটা যদি আমাদের ক্ষেত্রে হতো, তাহলে বরং আমাদের জন্য নেগেটিভ হইতো। এটা বরং পজিটিভ হইছে, যেইটা অন্য দশটা ব্যান্ডের ক্ষেত্রে বরং নেগেটিভই হবে। কারণ প্রপার সাউন্ডটা সে পাবে না তো, তখন তাদের প্রবলেম। কিন্তু আমাদের হইছে উল্টা– হেল্প।
তো, সামহাউ উই সারভাইভড, ফাইনালি। বাবু ভাই খুব ইমপ্রেশড হলেন। ইমপ্রেশড হয়ে বললেন, ‘আরেকটা গাও তো?’
ইউজুয়ালি অইখানে একটা গান, বা একটা গানের অর্ধেকই সবাই পারফর্ম করার পরে থামিয়ে দেওয়া হয় এবং চলে যেতে বলা হয়। আমাদের বরং বলা হলো, ‘আরেকটা গান গাও তো।’ তখন আসলে খুবই খুশি হলাম। আরেকটা গান করলাম। তারপরে বললেন, ‘এইগুলা তোমাদের সব নিজেদের গান? কাভার করো না?’
বললাম, ‘না, আমরা কাভার করি না।’
‘তোমাদের কি আরও গান আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে, আমাদের তো গান ৫০টার মতো।’
বললেন, ‘আরেকটা গাও তো?’
আমরা মোটামুটি চার থেকে পাঁচটা গান গাইলাম। মোমের আলো তো, ওনারাও মজা পাচ্ছিলেন, এনজয় করছিলেন। আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়ার পর তো ওনারা বাসায়ই চলে যাবেন; তো ওনারা বেসিক্যালি আমাদের গানগুলো একটা একটা করে শুনলেন। চার-পাঁচটা গান আমরা পারফর্ম করলাম। এবং উই অয়্যার সিলেক্টেড, ফরচুনেটলি। আমরা ফাইনালে গেলাম। ফাইনালের গালা প্রোগ্রামটা হয়েছিল শেরাটনে।… যাইহোক, এইটা একটা স্টোরি আরকি। এইটা বেনসন অ্যান্ড হেইজেস স্টার সার্চে’র গল্পটা বললাম।
শিরোনামহীন এরপরে, আমার মনে হয় যে, অই জায়গাগুলা প্রতিটাই আমাদের জন্য এক প্রকার ইন্সপাইরেশন ছিল। এবং আমরা বুস্টেড হলাম। বুস্টেড হওয়ার কারণে আমরা ব্যান্ডটাকে এগিয়ে নিতে শুরু করলাম।
মিউজিশিয়ানরা তো অনেক রকমেরই হতে পারে। অনেকে হয়তো সলভেন অবস্থা থেকে মিউজিক করতে এসেছে। (সেই তুলনায়) আমাদের ভালো ইনস্ট্রুমেন্ট ছিল না। আমরা একটু গরিব টাইপের ছিলাম। স্বচ্ছল ছিলাম না। মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট কেনা কিন্তু খুব এক্সপেনসিভ। যেটা পরবর্তীকালে আমাদের অনেকটা সলভেন হয়েছে। এই যে [সামনে থাকা বাদ্যযন্ত্র দেখিয়ে] সেলো… এটা ভেরি এক্সপেনসিভ ইনস্ট্রুমেন্ট, ভেরি এক্সপেনসিভ… এর চারটা তারের দামই এক লাখ টাকা। শুধু তার। এবং যেকোনো মুহূর্তে ছিড়ে যেতে পারে। সো, ভেরি এক্সপেনসিভ… মিউজিক করাটাই হচ্ছে একটা ভেরি এক্সপেনসিভ ডিল, যেটা ইউজুয়ালি মানুষ বোঝে না। সো, নোবডি অ্যাকচুয়ালি হেল্পিং মিউজিশিয়ানস।…
যাইহোক, অই সময়ে আমরা আসলে অ্যালবাম যে করব, অ্যালবামটা করতে পারছিলাম না। টাকার জন্যই পারছিলাম না। কারণ, এটা করতে রেকর্ডিং করতে হবে, পুরো ব্যাপারটাই এক্সপেনসিভ। অই এক্সপেন্স ব্যয় করাটা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যে কারণে আমরা রেকর্ডিং করতে পারিনি। আমাদের টাকা ছিল না।
এরপরে আরও একবার-দুইবার আমাদের লাইনআপ চেঞ্জ হলো। লাইনআপ চেঞ্জ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। সবাই তো ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ডে, ফ্রেন্ডসরা মিলে ব্যান্ড করেছি, কলেজ থেকে বেরিয়ে গিয়েছি, এখন ইউনিভার্সিটিতে যাব… তখন আমি বুয়েটে এন্ট্রি নিলাম, অই সময়টায় একবার চেঞ্জ আসলো লাইনআপে। মহীন ক্যুড নট কন্টিনিউ; সে দেশের বাইরে চলে যাবে। একটা সেটেল হয়ে গেল, দেশের বাইরে সে চলে গেল।

লেখাপড়ার জন্য কেউ যদি ঢাকার বাইরে একটা মেডিক্যালে চলে যায়, একটা ইউনিভার্সিটিতে চলে যায়, কেউ যদি দেশের বাইরে পড়ালেখার জন্য চলে যায়, অথবা চাকরির সুবাদে, কেউ যদি চাকরি করতে অন্য দেশে চলে যায়, তখনই কিন্তু ব্যান্ডের লাইনআপ চেঞ্জ হয় খুব স্বাভাবিকভাবে। এইটা হেপেনস টু এভরি ব্যান্ড। আমাদের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। লাইনআপ আবার চেঞ্জ হলো।
আমরা ২০০৪-এ আমাদের নতুন ভোকাল তুহিনকে নিয়ে (চলতে শুরু করলাম)। এটা খুবই স্ট্রাগল ছিল। কারণ এই গানগুলা তো কোনোটাই তার কণ্ঠে করা হয়নি। কিন্তু আমরা সেইভাবে এটা রেকর্ডিং করার ট্রাই করলাম, ২০০৩-এ। এটা হচ্ছে স্টোরিটা। তার গলায় সবগুলো গান তোলানো। তখন একদমই নতুন লাইনআপ। সারোদ বাজাত ফারহান, গিটারে তুষার জয়েন করল। তার মধ্যে তুষার একেবারেই সময় দিত না। মানে ইউজুয়ালি সে সময় দিত না ব্যান্ডকে; খুব কম দিত। এইসময় সে পড়াশোনার অংশ হিসেবে বুয়েট থেকে ইন্ডিয়া চলে যায় সফরে। সো, রেকর্ডিংয়ের টাইমটাতে ওকে আমরা অলমোস্ট পুরোটাই মিস করি।
…
শিরোনামহীন-এ
আমি গিটারিস্ট হিসাবেই
ছিলাম। পরবর্তীকালে বেজিস্ট হয়েছি
…
দ্যাটস হোয়াই জাহাজী অ্যালবামে মোটামুটি যা গিটার শোনা যায়, সেই গিটারগুলা, যদিও আমাদের একজন সেকেন্ড গিটারিস্ট ছিল– জুয়েল, সে-ও প্রপারলি ওভাবে আসলে কোপআপ করতে পারে নাই না কী হইলো, রেকর্ডিংয়ে বেশি অবদান রাখতে পারল না… মোস্টলি যেসব গিটার শোনা যায়, সেগুলা আমার বাজানো। এবং আই ওয়াজ অ্যা গিটারিস্ট ওয়ানস। শিরোনামহীন-এ আমি গিটারিস্ট হিসাবেই ছিলাম। পরবর্তীকালে বেজিস্ট হয়েছি।
অই অ্যালবামে গিটার, বেজ– আমাকে বাজাতে হয়, বড় একটা দায়িত্ব পালন করতে হয়। ইভেন, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আমাদের যেহেতু ছিল না, হোম স্টুডিওতে রেকর্ড করতেছি এক বন্ধুর বাসায়। আমার এক ফ্রেন্ড– ওর ওখানে গিয়ে আমরা বসে বসে প্রায় সাত-আট মাস ওকে জ্বালালাম। সাউন্ডটাও নিজেই করছি আমি। নিজে নিজেই করতাম।
করে দেখলাম, না, এগুলা দিয়ে তো আসলে হবে না, প্রফেশনাল একটা হেল্প লাগবে; চলে গেলাম ‘আর্ট অব নয়েজে’– যে, ‘আপনি আমাদের এই সাউন্ডটা মাস্টার করে দেন।’
উনি অনেক খুত ধরলেন, অনেক ভুল ধরলেন, আমার মনে আছে। বললেন যে, ‘এগুলোর তো রেকর্ডিং কোয়ালিটি খুব খারাপ হবে। গানগুলা খারাপ না। গানগুলা হয়তো চলে, ভালোই; খারাপ না। কিন্তু রেকর্ডিং কোয়ালিটি খুবই পুওর।’
…
জাহাজী
অ্যালবামের
সাউন্ড কোয়ালিটি
কিন্তু ভালো না। এত বছর
ধরে মিউজিক করতে
করতে এ বিষয়টাতে
অ্যাডমিট করতে
আমার কোনো
দ্বিধা
নাই
…
যেহেতু আমরা ইক্যুইপ্ট ছিলাম না; রেকর্ডিং কোয়ালিটি পুওর হবে, এটাই স্বাভাবিক। এবং দ্যাট ইজ হোয়াট হ্যাপেনড। যে কারণে জাহাজী অ্যালবামের সাউন্ড কোয়ালিটি কিন্তু ভালো না। এত বছর ধরে মিউজিক করতে করতে এ বিষয়টাতে অ্যাডমিট করতে আমার কোনো দ্বিধা নাই, এবং আমরা এটা শুরু থেকেই জানতাম, আমরা জানি। বাট আমাদের ডিফিকাল্টিজ ছিল– আমাদের টাকা ছিল না, আমাদের স্বচ্ছলতা ছিল না– আর্থিক; যে কারণে আমরা স্টুডিওতে যেতে পারিনি।
সেকেন্ডলি হচ্ছে, আমরা যে এক্সপেরিমেন্টেশনটা করেছি অই বন্ধুর বাসায়, দিনে পর দিন, একটা জিনিস বাজাচ্ছি, আর বাজিয়ে মনে হচ্ছে যে, এটা রাখব না, এভাবে-অইভাবে করব… এই যে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর, দীর্ঘ সময় রেকর্ডিং করার যে প্র্যাকটিসটা, সেটা শিরোনামহীন সব সময়ই চর্চা করেছে পরবর্তীকালেও। বাট জাহাজীতে ওইটা আমরা পারতাম না, যদি স্টুডিওতে প্রফেশনালি রেকর্ড করতে যাইতাম। কারণ, আমাদের যেহেতু স্বচ্ছলতা নাই, তার মানে টাইম ধরে কাজ শেষ করতে হবে– অই তাড়নাটা বেশি কাজ করত। সেই এক্সপেরিমেন্টেশনের জায়গা থেকে আমাদের বেশ উপকার হইছে।
মোরওভার, আমাদের লাইনআপ ছিল দুর্বল। মানে, আমাদের ব্যান্ডের মেম্বারদেরকে বেসিক্যালি কাজের সময় পাওয়া যায় না। হ্যাঁ? ভোকাল তো রীতিমতো থাকেই না; আসে না। খুব কম সময় দিত। আর গিটারিস্ট হচ্ছেন অ্যাবসেন্ট। তাহলে কাজ কীভাবে হবে?
অই, একা একা কাজ করে, কষ্ট করে কাজ করতে গেলে, সবকিছু তো একসাথে ইমাজিন করে ফেলা সম্ভব না। তার মানে, একটা লেয়ার দিয়ে, তারপর আরেকটা লেয়ার দিয়ে বুঝতে হবে– না, আগের লেয়ারটা ভুল হইছে। আমিও তো তখন খুব দুর্বল মিউজিশিয়ান। আমিও তো শিখছি। বিগিইনার টাইপ। বিগিইনার। আমাদের ফার্স্ট অ্যালবাম।
…
ফার্স্ট অ্যালবামে যখন কাজ
করেছিলাম, সবগুলো
হাউস থেকে
রিজেক্টেড
হয়েছিল
অ্যালবামটা; কেউ নেয় নাই, নোবডি
…
দেন অ্যাগেইন, সেকেন্ড অ্যালবামে যখন কাজ করলাম, তখন আমাদের এক ধরনের সাপোর্ট চলে এসেছে। কারণ, ফার্স্ট অ্যালবামে যখন কাজ করেছিলাম, সবগুলো হাউস থেকে রিজেক্টেড হয়েছিল অ্যালবামটা; কেউ নেয় নাই, নোবডি। প্রত্যেকটা জায়গায় আমরা সাবমিট করেছিলাম। তখন ভালো হাউস ছিল একটা– জি-সিরিজ লেবেল। প্রত্যেককে আমরা সাবমিট করেছিলাম অ্যালবামটা; এবং প্রত্যেকটা হাউস রিজেক্ট করেছিল।
তখন এই ‘সাত্বিক নাট্য সম্প্রদায়ের’ই একদম প্রধান কর্ণধার যিনি, সগীর ভাই, উনি এগিয়ে আসলেন; উনি বললেন, ‘আমার একটা লাইসেন্স আছে…।’ উনি তখন লালসালু (সিনেমায় কাজ করছেন), তানভীর মোকাম্মেল হচ্ছেন ডিরেক্টর, উনি ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। উনি বললেন, ‘আমাদের যে লাইসেন্সটা আছে, সেই লাইসেন্সে আমরা অ্যালবাম রিলিজ করতে পারি।’
বাই দ্য ওয়ে, এখনকার ছেলেপেলে এই গল্পটা রিলেট করতেই পারবে না! কারণ, ওরা তো জানে, একটা গান তৈরি করার পরে অনেক স্ট্রাগল… কেন? ‘কারণ, আমার এটা ইউটিউবে তুলতে হবে। ইউটিউবে ভিউ হবে নাকি…’– ওরা এইটা নিয়া চিন্তিত থাকে। ওরা এইটা বোঝেই না, গানটা রিলিজ করা সম্ভব না! আমাদের (সময়ে স্ট্রাগল) ছিল, গানটা রিলিজ করা। কারণ, ইউটিউব নাই তো। আমার গান আমি রিলিজ করতে পারব না। আমাকে লাইসেন্স রাখতে হবে এবং একটা হাউস থেকেই রিলিজ করতে হবে। আদারওয়াইজ আমি গান রিলিজ করতে পারব না। সেটা আমি যে-ই হই। এই বাস্তবতা ওরা দেখেই না। সো, ওরা এইটা বুঝতে পারবে না।
আমাদেরকে অই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হলো। (অ্যালবাম) জমা দিলাম। কিন্তু গান ভালো হয়েছে কি মন্দ হয়েছে, সেটা তো জানি না। গান তো রিজেক্টেড; অ্যালবাম রিজেক্টেড। একদম ছোট যেইসব হাউস আছে, স্টেডিয়ামের একেকটা ছোট ছোট দোকান, ওগুলাও কিন্তু একটা করে রেকর্ডিং হাউস ছিল, তখনকার লেবেল; তারাও আমাদের অ্যালবাম রিজেক্ট করেছিল।
তো, অই সগীর ভাই বললেন, ‘আমার লাইসেন্স দিয়ে অ্যালবাম রিলিজ করা সম্ভব এবং আমি রিলিজ করতে চাই; কারণ গানগুলা আমার ভাল্লাগছে।’ এবং র্যাপিড কমিউনিকেশনস নামে ওই হাউস থেকে আমাদের অ্যালবামটা রিলিজ হয়েছিল– জাহাজী।

পরবর্তীকালে জি-সিরিজ থেকে খালেদ ভাই একদিন আমাকে ফোন দিয়ে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘এই অ্যালবাম কেন আমার কাছে আসে নাই? এইটা বলো তো, তোমরা কেন আমাদের জি-সিরিজে সাবমিট করো নাই? এটা তো অনেক ভালো অ্যালবাম। এটা তো মার্কেটে হিট। এই অ্যালবাম তো আমরা রাখতে চাই।’
আমি বললাম, ‘আমরা সাবমিট অবশ্যই করেছি। আমি নিজে এসে দিয়ে গেছি।’
ইনফ্যাক্ট আমার আসলে সেন্ডেলের তলা ক্ষয় হয়ে গেছে, ছিড়ে গেছে সেন্ডেল… পাটুয়াটুলি, স্টেডিয়াম– এই জাতীয় জায়গার এই মাথা থেকে ওই মাথা খালি হাঁটাহাঁটি করতাম, প্রতিটা হাউসে অ্যাপ্রোচ করতাম। একেকটা হাউস আমাকে ২০ দিন, ২৫ দিন করে ঘুরাত।
‘বিটুবি’ নামে একটা হাউস ছিল পল্টনে। সেটাতে আমি ২০-২৫ দিন ঘুরছি। গেলেই দেখা যেত, কিছু মিউজিশিয়ান ওখানে বসে বসে খুবই জঘণ্য রুচির কিছু মিউজিক করতেছেন। জঘণ্য টাইপের আরকি। আমার রুচির সাথে যায় না। কিন্তু আমি হাসিমুখে সেখানে চুপচাপ বসে সহ্য করতাম। কারণ, আমি তো অ্যালবামটা রিলিজ করতে চাই: ‘অ্যালবামটা যদি দয়া করে রিলিজ করেন, তাইলে অনেক উপকার হয়।’
আমার ব্যান্ডের কেউ যায় নাই। আমাকে একা যাইতে হইছে এই জায়গাগুলোতে। কারণ, অন্যদের ভালো লাগে নাই। এমন একটা ব্যাপার যে, মনে হয় যেন আমার খুব ভালো লাগে! আমার কিন্তু ভালো লাগে নাই। জঘণ্য, পচা রুচির গানগুলা বসে শুনতে আমার অবশ্যই ভালো লাগেনি। কিন্তু যেহেতু অ্যালবামটা রিলিজ করার ডেসপারেশন ছিল, সো, আমি সেটা সহ্য করেছি। এবং দিনের পর দিন।
সেখানে একজন মহিলা আবার নাচতেন। সেই নাচও বসে বসে দেখতে হতো। এগুলা আমার কাছে পেইনফুল ছিল। কিন্তু এই পেইনটাও আমি খাইছি। কারণ আমি এই অ্যালবামটা রিলিজ করতে চাই। এবং সেইখান থেকেও কিন্তু… মাসখানেক পরে বুঝতে পারলাম যে, না, এদের এইখানে বসে বসে আসলে এই রকম পেইনই খাইতে হবে এবং প্রতিদিন আসা যাবে, কিন্তু তারা রিলিজ এই অ্যালবামটা করার ব্যাপারে সলিড কোনো কথা বলে না। “হ্যাঁ, ভালো তো! করা যাবে তো! ‘এগুলো’ একটু ঠিক করা যায় না?”– এই টাইপের কথাই খালি বলতে থাকে। প্রপার ওয়েতে আগাচ্ছে না।…

যাইহোক, ওইখান [র্যাপিড কমিউনিকেশন] থেকে রিলিজ হলো। পরে জি-সিরিজ থেকে বলল, ‘আমরা এই অ্যালবামটা রিলিজ করতে চাই, ইফ ইউ ওয়ান্ট।’
আমি বললাম, ‘সগীর ভাইয়ের সাথে তো আমাদের কথা আছে। তাহলে সগীর ভাইকে নিয়ে বসতে হবে।’
খালেদ ভাই অ্যাগ্রিড: ‘ওকে, ঠিক আছে। তাইলে ওনাকে ডাকা হোক। তুমি নিয়া আসো।’
সগীর ভাইকে বললাম, ‘চলেন ভাই, একটু যাই। ওরা তো অ্যালবামটা রিলিজ করতে চায়।’
সগীর ভাইয়ের জন্যও এইটা [অ্যালবাম] খুব পেইনফুল ছিল। কারণ, ওনার তো আর (রেকর্ডিং লেবেল) হাউস না। সো, এই যে অ্যালবাম চাইছে বিভিন্ন জায়গা থেকে, ঢাকার বাইরে-টাইরে থেকে, উনি আসলে সলিড ওয়েতে সেটা সাপ্লাই করার জন্য প্রস্তুতও না, পারতেছেনও না; ফেইল করতেছেন বারবার। উনি বলতেছেনও, ‘আমি তো আসলে এইটার ডিস্ট্রিবিউশনটা ঠিকমতো করতে পারতেছি না। কিন্তু এই অ্যালবামটার অনেক চাহিদা আছে।’
চাহিদা না থাকলে জি-সিরিজ আমাদের ডেকে নিত না, এটা হচ্ছে প্রথম কথা।
যাইহোক, খালেদ ভাই তখন আমাদের সাথে তিনটি অ্যালবামের চুক্তি করলেন, এবং আমরা সেই আনন্দে স্টারে গিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি খেলাম! আমার পরিষ্কার মনে আছে। খুবই আনন্দের ঘটনা। অন্তত এর পরে আমাদের রিজেক্টেড হতে হবে না; গান বাজনা আরও দুইটা অ্যালবাম পর্যন্ত আমরা করতে পারব, আশা করতেছি।
জাহাজী ওয়াজ অ্যা হিট অ্যালবাম। আমাদের দেশের ইতিহাসের যে কয়টা অ্যালবাম মেগাহিট– এইভাবে যে মেনশন করা হয়, তার মধ্যে জাহাজীও অন্যতম। যে কারণে ইচ্ছেঘুড়ি, মানে সেকেন্ড অ্যালবামটার জন্য খুব প্রেসার আমাদের জি-সিরিজ থেকে করা হচ্ছিল: ‘হ্যাঁ? তোমরা সেকেন্ড অ্যালবামটা কেন করছ না? করো, তাড়াতাড়ি কাজ করো। আমরা সবকিছু প্রোভাইড করতেছি…।’ সাউন্ড গার্ডেন আমাদের জন্য বুক করে দেওয়া হলো।
…
আমাদের ভোকাল যথেষ্ট পেইনফুল।
ওনার আসলে সবসময় সময় হয়
না। ওনার যেদিন মর্জি হয়,
সেদিন এসে গান কানে
তুলবেন; ভয়েস
দিতেও পারেন,
না-ও
দিতে
পারেন…
তো এ রকমভাবেই
আমাদের ব্যান্ড আবারও চলল
…
…এবং দেন অ্যাগেইন, আমাদের ব্যান্ডের যেটা কমন সমস্যা, যেটা এর আগেও ঘটেছে, এবারও ঘটল: আমরা আমাদের গিটারিস্টকে ওভাবে পাচ্ছি না, এবং আমাদের ভোকাল যথেষ্ট পেইনফুল। ওনার আসলে সবসময় সময় হয় না। ওনার যেদিন মর্জি হয়, সেদিন এসে গান কানে তুলবেন; ভয়েস দিতেও পারেন, না-ও দিতে পারেন… তো এ রকমভাবেই আমাদের ব্যান্ড আবারও চলল। সেকেন্ড অ্যালবামটা হলো। তারপরে আমরা স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করি।
এর পরবর্তী গল্পগুলা আমাদের ডিফারেন্ট। অনেক ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। কারণ, তখন আমরা স্টেজ কল পাচ্ছি। স্টেজ হচ্ছে আমাদের জন্য, আর্টিস্টদের জন্য একমাত্র সোর্স অব ইনকাম– যেটা দিয়ে ব্যান্ড চলবে। কারণ, ব্যান্ড চালাতে তো টাকা লাগে। আমি তখনই ভালো কোনো মিউজিক করতে পারব, যখন আমার পকেটে টাকা আছে এবং আমার স্টুডিও– এই সাপোর্টগুলা আছে, এবং কারও ওপরে আমার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না; যে কাজটা করতে চাই, সেইটা করতে পারি। কারণ, করার সুযোগটা তো দিতে হবে। সেইটার জন্য যে স্বচ্ছলতার প্রয়োজন, সেইটা কিন্তু থাকতে হয়।

আদারওয়াজ, স্ট্রাগল করতে হয়। আমরা যেটা করেছি দুই অ্যালবামে। থার্ড অ্যালবামে গিয়া অইটুকু স্বাবলম্বী হইতে পারলাম। বন্ধ জানালা। অইটাতে আমার মনে আছে, আমি যথেষ্ট ফ্রিডম নিয়ে কাজ করতে পারছি। অ্যাকোডিং টু… আমার মনের মতো। এর আগে যেমন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের ওপর ডিপেন্ড করতে হইছে।
জাহাজী ওয়াজ দ্য ফার্স্ট অ্যালবাম, যেইটায় আমি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিজে কাজ করছি, এবং নিজের হাতে ফুল প্রোডাকশনটা নামাইতে পারছি। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ-এও তা-ই। শিরোনামহীন শিরোনামহীন-এও তা-ই। নিজের স্টুডিওতে আমি যুদ্ধ করছি। সো, অইটা তখন তৈরি হয়েছে। এবং (শিরোনামহীন-এর) মোটামুটি ক্রনোলজিটা আসলে এই-ই।
এখনো যে আমরা কাজ করছি, এখনো শিরোনামহীন অই একইভাবেই চায়, যে, আমাদের ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’টা, বা আমাদের এক্সপেরিমেন্টেশনের জায়গাটা যাতে কোনোভাবেই বিপণ্ন না হয়। এইজন্য আমরা অই জায়গাটায় সবচেয়ে বেশি কেয়ার করি আরকি। অইটা যাতে কোনোভাবেই বিপণ্ন না হয়। যেই কারণে আমরা অনেকের ক্ষেত্রে হয় না, যে, অনেক অপরচুনিটি আছে, অনেক বড় স্টুডিও আছে, যেখানে আমাদের যাওয়ার সুযোগ আছে, অফার আছে, কেউ হয়তো সেটায় প্রলুব্ধও হবে? কিন্তু আমরা সেটা হই না।
কারণ, গান হচ্ছে একটা সার্টেন ইমোশন। আমি সঠিকভাবে আমার ইমোশনটা যদি ডেলিভার করতে পারি এবং সেটা ট্রান্সলেটেড না হয়ে গিয়ে ঠিক ওভাবেই যদি কনভেইড হয়– টু পিপল, তাহলেই কিন্তু শ্রোতা সেই গানটাকে আবেগের জায়গা থেকে রিসিভ করবে। আমার কাছে এইটা খুব ইমপোর্টেন্ট। আমার কাছে ভিউ ইমপোর্টেন্ট না।

যেমন, একজন দেখছে, সেটা ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে, আরেকজনকে বলতেছে, বা খুব হাসাহাসি করতেছে সেইটা নিয়ে– সেইজন্য ভাইরাল হইছে, এই জিনিস আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি ঘটে পৃথিবীর মধ্যে। ভাইরাল হচ্ছে– অইটা একটা ইস্যু; আরেকটা ইস্যু হচ্ছে, আমার একটি গান একজন মানুষকে এতটা টাচ করেছে, যে, সে যখন খুব বিপদে পড়ে, তখন অই গানটা শোনে; কারণ অই গানটা তাকে একটা শক্তি দেয়। সে যখন খুব আনন্দেতে থাকে, তখন অই গানটা শোনে; কারণ অই গানটা তার অই সময়টায় শুনতে ভালো লাগে।
আমার মনে হয় যে, অই জায়গাটা হচ্ছে মিউজিশিয়ানদের সবচেয়ে ইমপোর্টেন্ট জায়গা। যাদের গানের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা ঘটে, তাদের গানই ঠিক; বাকিদের গান অইভাবে সফল হয়নি– বলতে হবে।