লিখেছেন: ব্রায়ান হাইয়েট
অনুবাদ: রুদ্র আরিফ

১৯৮৩ সালে এডি ভ্যান হ্যালেন যখন হলিউডের কাছে এক পাহাড়ে নিজের অনেক ভালোবাসার ৫১৫০ হোম স্টুডিওটি প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন, সেটির কিচেন সাজিয়েছিলেন ৫ হাজার মাইলেরও বেশি দূরের একটি শহরের এক হোঁতকা পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ছবি দিয়ে। সারা রাত জেগে রেকর্ডিং সেশন করার দিনগুলোতে যতবারই বিয়ার নিতে ফ্রিজের কাছে যেতেন, দেখতে পেতেন নেদারল্যান্ডসের জার্মান সীমান্তবর্তী গেল্ডারল্যান্ড প্রোভিন্সের নেইমেজেন শহরের ৫৯নং রোজামারিন্সট্রাটের সেই বাড়ির ছবি– যেখানে জীবনের প্রথম সাতটি বছরের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছেন।
দন্তবিকশিত হাসির অধিকারী এডি সেই দ্য বিচ বয়েজ [১৯৬১-] ব্যান্ডের সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে স্বতন্ত্ররূপে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ান ব্যান্ডের একজন সর্ব-আমেরিকান গিটার জিনিয়াস ও মিউজিক্যাল মাস্টারমাইন্ড, যিনি ছিলেন এমন এক বিজাতীয় অভিবাসী– সাত বছর বয়স হওয়ার আগ পর্যন্ত বলতে গেলে একটিও ইংরেজি শব্দ বলতে পারতেন না। তার বাবা ছিলেন ডাচ; মায়ের জন্ম ইন্দোনেশিয়ায়। তাই তিনি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ান ও ডাচ পূর্ব পুরুষের বংশধর। নিজের গড়া ভ্যান হ্যালেন ব্যান্ডের শুরুর দিকে, এডি ও তার বড় ভাই– ওই ব্যান্ডের ড্রামার অ্যালেক্স যখনই কোনো কারণে ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার চ্যাচামেচি করতেন, তখন তাদের মুখ দিয়ে অনর্গল ডাচ ভাষা বের হতো।
‘এটি আমার দেখা সবচেয়ে আজব কাণ্ডের একটি,’ লিখেছেন তাদের এককালের ম্যানেজার নোয়েল মঙ্ক। ‘এই দুই মূলত শান্ত স্বভাবের রকার– যাদের কথা বলার সময় সাধারণত বোকা-বোকা দেখাত, আচমকাই পরস্পরের প্রতি নাকে নাক রেখে, থুতু ছিটিয়ে, খেঁকিয়ে উঠে ও গর্জন করতে করতে একটা বিদেশি ভাষায় এমনভাবে কথা বলতে শুরু করে দিতেন, যেন তারা ভূতগ্রস্ত।’
২০২০ সালের ৬ অক্টোবর ক্যানসারে মারা যাওয়া এডি ছিলেন নিজের অন্তঃস্থল থেকে একজন চিরকালীন বালকসুলভ, মিষ্টি স্বভাবের মহাবিস্ময়কর মানুষ। মঞ্চে গিটার হাতে যে আনন্দ তিনি ছড়িয়ে দিতেন– তা ছিল নিখাদ ও প্রগাঢ়। তবে তার আবেগাত্মক জীবনে অন্ধকার প্রবাহও ছিল, যেগুলো ভাষায় প্রকাশ করতে পারতেন না; এমনকি সবচেয়ে কাছের মানুষদের কাছেও না। হাই স্কুল জীবনের উত্থান-পতন, এবং কখনো কখনো স্বয়ং স্কুলকেই তিনি এড়িয়ে গেছেন– বেডরুমে গিটার নিয়ে সময় কাটিয়ে ও সিক্স-প্যাক বানিয়ে। জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছেন নিখাদ মিউজিকের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করে; আর হোটেল রুম কিংবা নিজের স্টুডিওতে এক অনন্ত, ধ্যানগ্রস্ত ও মদে ভরা জ্যামে মগ্ন থেকে। ‘এটি মহাজাগতিক ভাইব্রেশন,’ ২০০৭ সালে আমাকে বলেছিলেন তিনি। ‘এটি নিরাময় দেয় আমাকে।’

‘সে যখন বাজাত,’ তার প্রাক্তন স্ত্রী ভ্যালেরি বার্টিনেলি লিখেছেন, ‘একান্তই নিজের দুনিয়ার ভেতর অদৃশ্য হয়ে যেত। সেখানেই সবচেয়ে বেশি স্বস্তি পেত সে; যা কিছুই করত, এর সবই ছিল স্বয়ং নিজেরই বেছে নেওয়া। এই অন্তর্জাগতিক দুনিয়াটি আমাকে শেষের দিকে বিভ্রান্ত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ করে তুললেও শুরুতে ছিল বেশ প্রলোভন জাগানিয়া।’
মোকাবেলা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল তার; নিজের হতাশাগুলোকে বড় হয়ে উঠতে দিতেন। ১৯৮২ সালে ড্যান্সিং ইন দ্য স্ট্রিট-এর কাভার করার সময় এডি চেয়েছিলেন একটি মৌলিক গান তৈরি করতে, অথচ ব্যান্ডের ফ্রন্টম্যান ডেভিড লি রথ ও প্রডিউসার টেড টেম্পলম্যান তাতে এক ফাঙ্কি সিন্থ রিফ জুড়ে দিলে তিনি প্রতিরোধ করেননি ঠিকই, কিন্তু সেই দৃশ্যত অতি সামান্য সংযোগ নিয়ে পরে দশকের পর দশক ধরে তিক্তভাবে নালিশ তুলে গেছেন।
…
তার বাজনার
মধ্যে যেকোনো
সময়ই চিরহাজির
অনিষ্ট ও অপার্থিব
পুণ্যের পাশাপাশি
ক্রোধ ও বেদনা
ঝরে পড়ে
…
তার বাজনার মধ্যে যেকোনো সময়ই চিরহাজির অনিষ্ট ও অপার্থিব পুণ্যের পাশাপাশি ক্রোধ ও বেদনা ঝরে পড়ে। ভ্যান হ্যালেন-এর সবচেয়ে হেভি অ্যালবাম, ১৯৮১ সালের ফেয়ার ওয়ার্নিং-এ সম্ভবত এর সবচেয়ে বেশি প্রমাণ রয়েছে; তবে একেবারেই শুরুর দিক থেকেই, তার বাজনাগুলোকে তার মায়ের কাছে অতি উচ্চস্বরে ‘কান্না’ বলে মনে হতো।
তার মেকআপের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ আত্ম-ঘৃণা ছিল। মা তাকে অনেক কষ্টে জোর করে পাঠিয়েছিলেন ক্লাসিক্যাল পিয়ানো শেখার ক্লাসে, যার ফলে নিজের বেড়ে ওঠাকে এডি হরদমই শাইন সিনেমার সঙ্গে তুলনা করতেন; তার বাবা-মায়ের এমন চাপ প্রয়োগ একজন মিউজিক্যাল মহাবিস্ময়কে একটি মানসিক ব্রেকডাউনে ঠেলে দিয়েছিল। “বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি দিনগুলোতে মা আমাকে ‘ঠিক যেন বাপের মতো একটা গর্দভ হয়েছিস’ বলে ডাকতেন,” বলেছিলেন তিনি গিটার ওয়ার্ল্ডকে। ‘যদি এভাবে বেড়ে ওঠেন, তাহলে আত্মমর্যাদার কোনো লেশ থাকবে না আপনার মধ্যে।’

একইসঙ্গে, তার অনিবার্যভাবে শুরুর দিনগুলো ঘিরে পর্যায়ক্রমিক রূপে গ্রেগ রিনোফের লেখা জীবনীগ্রন্থ ভ্যান হ্যালেন রাইজিং: হাউ অ্যা সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিংয়া ব্যাকইয়ার্ড পার্টি ব্যান্ড সেভড হেভি মেটাল থেকে জানা যায়, ভ্যান হ্যালেন ভ্রাতৃদ্বয়ের বাবা-মা যথেষ্ট সহায়তাপ্রবণও ছিলেন; নিজেদের খরচ থেকে টাকা জমিয়ে অ্যালেক্সকে একটি ড্রাম কিট এবং এডিকে একটি গিবসন লেন পল (গিটার) সেই ১৯৬৯ সালেই কিনে দিয়েছিলেন তারা।
এডির যখন ২৫ বছর বয়স, ততদিনে তিনি বেশ কিছু প্লাটিনাম অ্যালবাম ইতোমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছিলেন; আর তখনো থাকতেন বাবা-মায়ের সঙ্গেই। জীবনের সেই পর্যায়েও এডির মিউজিক ক্যারিয়ার নিয়ে তার মা ভরসা পাচ্ছিলেন না; বরং ছেলেকে স্কুলে ফেরত পাঠানোর দিতে থাকেন চাপ।
জাম্প গানের মাধ্যমে অল্পবয়সের সাফল্যের চূড়ায় উঠে যাওয়া, গানটি এমটিভিতে দুনিয়াজুড়ে চালানোর সেই সময়কালেও, নিজেকে ‘নির্বোধ’ ভাবার ভয় মনে কাজ করত বলে তিনি স্বীকার করেছেন। একই বছর আরেক সাক্ষাৎকারে নিজেকে ‘স্বার্থপর’ ও একজন ‘সিক ফাক’ বা ‘অসুস্থ লেবেলের আচোদা’ বলে গালি দেন তিনি। অবশ্য, ‘এড, তুমি মানুষটা খুব ভালো,’ নিজ স্মৃতিকথার উৎসর্গপত্রে লিখেছেন বার্টিনেলি। ‘এ কথা বিশ্বাস করো। যখন করবে, তখন দেখবে– তুমি মুক্ত।’
এমনকি যদিও সবচেয়ে রোমাঞ্চকর জীবিত গিটারবাদক হিসেবে তার ব্যাপক সুনাম ছিল, যদিও তাকে টেম্পলম্যান তুলনা করেছিলেন বাখ ও চার্লি পার্কারের সমতুল্য হিসেবে, তবু নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি এডিকে জর্জরিত করত; আর নিজের দুশ্চিন্তা-রোগ সারানোর জন্য তিনি আক্ষরিক অর্থেই হাত বাড়াতেন মদের দিকে, কখনো কখনো কোকেইনের দিকেও। ‘যখনই স্টুডিওতে যাই, মনে হয় যেন জীবনে প্রথমবার এলাম,’ ১৯৯৬ সালে বলেছিলেন তিনি। ‘যেন এর আগে কোনোদিনই গান লিখিনি। তাই এত ভয়-ভয় লাগছে।’
…
‘সহজেই
ভড়কে যাই। আর
এ কারণেই
মদ খাই’
…
ঠিক নিজের বাবা ও ভাইয়ের মতো তিনিও ছিলেন একজন অ্যালকোহলিক। ব্যান্ডটির সাফল্যের প্রথম দশকের পুরোটা সময়জুড়ে ‘সংযত’ দিন তিনি একটিও কাটাননি। ‘আমি আসলে লাজুক, নার্ভাস লোক,’ তিনি বলেছেন ১৯৯৮ সালে। ‘সহজেই ভড়কে যাই। আর এ কারণেই মদ খাই।’ বছরের পর বছর শত চেষ্টা করেও, ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত এ অভ্যাস থেকে রেহাই পাননি তিনি।
ইলেকট্রিক গিটারিস্টদের বাজানোর ধরনই পাল্টে দিয়েছিলেন এডি ভ্যান হ্যালেন: নিজ সাউন্ড আত্মস্থ করার জন্য নিরন্তর লড়ে গেছেন, এমনকি তাদের ব্যবহৃত ইনস্ট্রুমেন্টগুলোর ফিজিক্যাল কনস্ট্রাকশন সহকারে। এর অনেকগুলোই প্যাটেন্ট রয়েছে তার নামে (এবং অন্যান্য টেকনিক্যাল ব্রেকথ্রুও এনে দিয়েছেন তিনি– যেগুলো, প্যাটেন্ট অফিসের সঙ্গে কীভাবে কাজ করতে হবে, তা তিনি জানার আগেই অন্যরা হাত করে নিয়েছে)। নিজের একলা হাতে ইলেকট্রিক গিটারকে তিনি একটা বাড়তি দশক আয়ু দিয়ে গেছেন কিংবা করে গেছেন সাংস্কৃতিকভাবে আরও বেশি গুরুত্ববহ; এমনকি, যারা ‘টাইপরাইটারদের মতো বাজায়’– এমন একটি টিজড-হেয়ার শ্রেডার প্রজন্মের জন্য কাজ করারও চেষ্টা করে গেছেন।
তবে তিনি স্রেফ একজন গিটারিস্টই ছিলেন না। বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর আগেই এডি ছিলেন একজন পুরস্কারজয়ী পিয়ানো প্রতিভা; এমনও সময় গেছে, যখন এক বছর গিটার ছুঁয়েও দেখেননি, বরং পিয়ানো ও সিনথেসাইজারে নতুন নতুন সুর তুলে সময় কাটিয়েছেন। মধ্য বয়সে এসে সেলো’কে তিনি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন; (আমেরিকান সেলিস্ট) ইয়ো-ইয়ো মা’র সঙ্গে রাত জেগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেলো বাজিয়েছেন। বন্ধুরা বলেন, স্যাক্সোফোন, হারমোনিকা– এ রকম ‘অপ্রত্যাশিত’ বাদ্যযন্ত্র হাতে নিলে তিনি সেগুলো যেন একদম পেশাদার পর্যায়ে বাজাতে পারতেন।
তার সবচেয়ে অটুট বন্ধনগুলো ছিল পারিবারিক। কৈশোরে পা রাখার আগে থেকে শুরু করে ক্যারিয়ারের একেবারেই শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি আর অ্যালেক্স একসঙ্গে বাজাতেন। তাদের প্রথম ব্যান্ড ব্রোকেন কম্বস-এ এডি বাজাতেন পিয়ানো; অ্যালেক্স বাজাতেন স্যাক্সোফোন। তাদের মধ্যে একটি অলৌকিক ধরনের মিউজিক্যাল বন্ধন ছিল; তারা একে অন্যের রিদমিক টুইস্ট মুহূর্তেই ধরে ফেলতে পারতেন, যেন দুজনে মিলে একটিই মিজিক্যাল বুদ্ধিমত্তা। ‘বেজ ও ড্রামস নয়, গিটার ও ড্রামস নিয়ে রক অ্যান্ড রোলে আমরাই সম্ভবত ছিলাম একমাত্র রিদম সেকশন,’ এডি বলেছিলেন আমাকে।

দাম্পত্যজীবনের শুরুর দিনগুলোতে বার্টিনেলিকে বলেছিলেন, তিনি যথেষ্টসংখ্যক সন্তানের বাবা হতে চান, যেন ওদের নিয়ে আস্ত একটা ব্যান্ড গড়তে পারেন। তাদের একমাত্র সন্তান উল্ফগাং যখন বার্টিনেলির গর্ভে, জরায়ুতে থাকা সেই সন্তানকে এডি গিটার বাজিয়ে শোনাতেন। তার ছেলেও খুবই অল্প বয়সে একজন জন্মগতপ্রতিভাধর মাল্টি-ইনস্ট্রুমেন্টালিস্ট হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ভ্যান হ্যালেন ব্যান্ডে বেজিস্ট হিসেবে যোগ দেন উল্ফগাং; এ ঘটনায় এডি যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন (ব্যান্ডে নিজের জায়গা হারানো বেজিস্ট মাইকেল অ্যান্থনি নিশ্চিতভাবেই হয়েছিলেন নাখোশ)। ‘ওকে স্কুল থেকে বাড়ি আনার কাজ প্রতিদিন আমিই করতাম,’ আমাকে বেশ গর্ব নিয়ে বলেছিলেন এডি, ‘তারপর মিউজিক করতাম দুজন মিলে। ও একটা যা-তা লেবেলের বাচ্চা!’
ভ্যান হ্যালেন-এ লিড সিংগার আসা-যাওয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা, তবে এই গ্রুপ এডি কিংবা অ্যালেক্স কোনোদিনই ছাড়েননি, ছাড়তে চানওনি (শুধুমাত্র ভোকাল হিসেবে রথের থাকার দিনগুলোকে এডি মাঝে মধ্যে ব্যান্ড ছাড়ার হুমকি দিতেন, সে কথা ভিন্ন)। ব্যান্ডটি ছিল তাদের নামে; তাদেরই ব্যান্ড। একবার রসিকতা করে এডি বলেছিলেন, ভ্যান হ্যালেন-এ তার মেয়াদ অস্থায়ী: ‘যতদিন বেঁচে আছি, শুধু’ ততদিনই!
এডি ও অ্যালেক্সের বাবা জ্যান ছিলেন একাধারে একজন পাঁড় মাতাল, ক্ল্যাসিক্যালি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্যাক্সোফোনিস্ট ও ক্লেরিনেটিস্ট– যিনি বড় বড় ব্যান্ডবাদক দলে ব্লেজিং সলো জাহির করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডাচ রেজিস্টেন্সের হয়ে যুদ্ধ করার পর জ্যান ইন্দোনেশিয়ায় চলে যান; দেশটিতে ডাচ উপনিবেশের শেষ দিনগুলোর সময়কাল ছিল সেটি। সেখানে ইউজেনিয়া ভ্যান বিয়ারস নামে এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হলে তাকে বিয়ে করেন। সেই নারী ও তার স্বামী যখন নেদারল্যান্ডে ফিরে সংসার শুরু করেন, তখন জ্যানের মিউজিক্যাল ক্যারিয়ার উঠতির দিকে থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে বর্ণবাদের শিকার হতে হয় তাদের। ‘আমার মা পরিণত হন একজন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে,’ স্মৃতিচারণায় বলেছেন এডি, ‘কেননা, তিনি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ান।’
তাদের নিজেদের সম্পদ বলতে তখন শুধু ৭৫ গিল্ডার [ডাক অর্থমুদ্রা] আর একটা পিয়ানো সঙ্গে নিয়ে চল্লিশোর্ধ ওই যুগল এক সময় এডি ও অ্যালেক্সকে সঙ্গী করে ৯ দিনের নৌকা-যাত্রায় আমেরিকায় পাড়ি জমান। পুরো যাত্রায় ওই নৌকার ব্যান্ডে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে যাত্রা খরচ মিটিয়েছেন জ্যান; সঙ্গে এডি আর অ্যালেক্সও করেছেন পারফর্ম। সেই পারফরম্যান্সের উপহার হিসেবে তারা কাপ্তানের ডিনারের টেবিলে একটা জায়গা করে নিয়েছিলেন– সেই স্মৃতি এডি কোনোদিনই ভোলেননি। নৌকাটি নিউইয়র্কে এসে ভিড়ে; তারপর একটি ক্রস-কান্ট্রি ট্রেন যাত্রা শেষে ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনায় বসত ঘরে ওই পরিবার।
নতুন দেশে তাদের নতুন জীবন অন্তত শুরুর দিকে ছিল একেবারেই হতাশার। লোকেদের বাড়িতে পয়পরিষ্কারের কাজ করতেন ইউজেনিয়া; ছয় মাইলের রাস্তা হেঁটে আসা-যাওয়া করে একটি হাসপাতালে থালাবাসন ধোয়ার কাজ করতেন জ্যান। সেইসব বিগ ব্যান্ড তখন মৃত; তবে একটি মিউজিক ক্যারিয়ারের এক আভাস পুনর্গঠন করেছিলেন জ্যান: একটি পলকা ব্যান্ডে বাজাতেন তিনি, যেখানে মাঝে মধ্যে ড্রামসে বাবাকে সঙ্গ দিতেন অ্যালেক্স।
এ সময়ে স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হন এডি, অন্তত শ্বেতাঙ্গ শিশুদের কাছে। ‘আমি ইংরেজি বলতে পারতাম না। আমি সংখ্যালঘু বলে ওরা আমার পাছায় হরদম লাথি মারত,’ ১৯৯৮ সালে বলেছেন তিনি। ‘আমার সব বন্ধু ছিল কৃষ্ণাঙ্গ; ওরা আমার পাশে দাঁড়াত।’ এমনকি পিয়ানো ক্লাসে একজন বয়স্ক রুশ মিউজিশিয়ান রুলার দিয়ে নির্মমভাবে পেটাতেন এডি ও অ্যালেক্সকে; সেসবও সহ্য করতে হয়েছে তাদের।
অবশেষে তারা যখন রক অ্যান্ড রোল শুনলেন, তখন আমেরিকায় তাদের জীবন শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি দেখাতে শুরু করল। দ্য ডেভ ক্লার্ক ফাইভ ব্যান্ডের দুর্দান্ত রকমের নয়েজি গ্ল্যাড অল ওভার গানটির স্নেয়ার-হেভি বিটের সঙ্গে পরিচিত হওয়ামাত্রই এডি বুঝে গেলেন, নিজের মিউজিক্যাল নিয়তি খুঁজে পেয়েছেন: তাকেও ক্লার্কের মতো একজন রক অ্যান্ড রোল ড্রামার হতে হবে।
‘আমি আর আমার ভাই মডেল কার বানাতে অভ্যস্ত ছিলাম,’ আমাকে বলেছিলেন এডি, ‘চেরি বোমা আর লাইটার ফ্লুইড দিয়ে মডেল কারগুলো আমরা উড়িয়ে দিতাম। তারপর সবগুলো প্ল্যাস্টিক পার্ট কুড়িয়ে এনে বক্সে ভরতাম। বক্স ভরে উঠলে এগুলো থেকে রেকর্ডের মতো সাউন্ড বের করার চালাতাম চেষ্টা।’
একটি ড্রাম কিটের দাম মেটানোর জন্য একটি পেপার রুট পেয়েছিলেন তিনি, এমনকি অ্যালেক্স শুরু করেছিলেন ফ্লেমেঙ্কো গিটারের পাঠ নেওয়া। “যখন থ্রোলিং পেপারগুলো ফুরিয়ে যেত, তখন আমার ড্রামস বাজানো শুরু করত ভাই; আমার চেয়ে ভালো বাজাত সে, তাই বলতাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, চুদি তোরে, আমি তোর গিটার বাজাব।’”

বাচ্চা বয়সে এডি আর অ্যালেক্স একসঙ্গে নিরন্তরভাবে বাজিয়ে গেছেন, যখন অন্য মিউজিশিয়ানরা ছিলেন আসা-যাওয়ার মাঝে। তাদের প্রথম গিগিং ব্যান্ড ছিল ট্রোজান রাবার কোম্পানি; ১৯৭১ সালের দিকে জেনেসিস নামে একটা পাওয়ার ট্রায়ো গঠন করেন তারা। পরবর্তীকালে বেজে মার্ক স্টোন নামে এক বালককে দলে বেড়ান। ফ্রন্টম্যান হিসেবে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতেন এডি। তিনি যখন কণ্ঠ থামাতেন, মাইকেল অ্যান্থনির সঙ্গে তার হারমোনি ভ্যান হ্যালেন-এর সাউন্ডের ক্ষেত্রে একটা মেরুদণ্ড হয়ে উঠত; তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভোকাল হয়ে উঠেছিল অনেকটাই গৌণ বিষয়।
পরবর্তীকালে দেওয়া আক্ষরিক অর্থেই প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই এডি জানিয়েছেন, তাকে নিবিড়ভাবে অনুপ্রাণিত করেছে এরিক ক্ল্যাপটনের ক্রিম-যুগের পারফরম্যান্স। তাতে অভিভূত হয়ে তিনি সে সময়ে ক্ল্যাপটনের বাজনার ভেতর একটি স্যাক্সোফোন-তুল্য স্বর ও ভঙ্গিমা খুঁজে পেয়েছিলেন, এবং ক্ল্যাপটনের সলোগুলো নোট ধরে ধরে নিয়েছিলেন শিখে।
অ্যালেক্স ও এডি যে বেডরুমে থাকতেন, সেটির দেয়ালজুড়ে ছিল ক্ল্যাপটন ও জিঞ্জার বেকারের পোস্টার। এডি একবার গিটার ওয়ার্ল্ড-এ বলেছেন, ক্রিম “একদিক থেকে মিউজিককে রোমাঞ্চকর করে তুলেছিল, যা লোকে সত্যিই বুঝতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। সেখানে গানের কথা ও প্রকৃত গানটির স্ট্রাকচারের গুরুত্ব ছিল যেন দ্বিতীয় সারিতে। (আমরা ভাবলাম,) ‘এইসব ফালতু জিনিস উৎরে গিয়ে চলো আমরা মিউজিক বানাই আর দেখি মিউজিক আমাদের আজ রাতে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায়।’”
সত্তরের দশকের বেশিরভাগ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন নিজের ভাইয়ের সঙ্গে বাজিয়ে, যা ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে তাদেরকে সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ কাভার ব্যান্ডে পরিণত করেছিল; হুর পিট টাউন্সহেন্ড, লেড জেপলিন-এর জিমি পেজ, ব্ল্যাক সাবাথ-এর টনি আইওমি, এরোস্মিথ-এর জো পেরি, জেডজেড টপ-এর বিলি গিবন্স (বিয়ার ড্রিঙ্কারস অ্যান্ড হেল রেইজারস গানে যার অংশটি সলোতে চাগিং রিফ থেকে শুরু করে একটি কুইক টু-হ্যান্ড-অন-দ্য-ফ্রেটবোর্ড মোমেন্ট পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে ভ্যান হ্যালেনধর্মী) এবং আরও অসংখ্যজন– প্রতিটি তুখোড় হার্ডরক ও মেটাল গিটার প্লেয়ারের স্টাইলকে এডি আত্মস্থও করে ফেলেছিলেন। (পরবর্তীকালে তিনি ফিউশন-যুগের জেফ বেকের দিকে মনোযোগ দেন, এবং অ্যালান হোল্ডসওয়ার্থের ফ্লুইড ও হারমোনিক্যালি অ্যাডভেঞ্চারাস প্লেয়িং থেকে গ্রহণ করেন বিশেষ অনুপ্রেরণা।)
…
এডি
নিজ হাতে
গিটারে দ্রুতগতির
ঝড় তুলে ১৫ বছর বয়সেই
একজন আঞ্চলিক কিংবদন্তিতে পরিণত হন
…
শুরুর দিকে দুটি গানের বাজনার ঋজু গতি এডির কানে ধরা পড়ে তার ইনস্ট্রুমেন্টের সম্ভাব্যতাকে নিজ বোধে ছড়িয়ে দিয়েছিল: টেন ইয়ারস আফটার-এর আ’ম গোয়িং হোম-এ অ্যালভিন লি, এবং ক্যাকটাস-এর পার্চম্যান ফার্ম-এর ফ্রেনটিক ভার্সনে আন্ডাররেটেড গিটারিস্ট জিম ম্যাকক্যারির বাজনা। এডি নিজ হাতে গিটারে দ্রুতগতির ঝড় তুলে ১৫ বছর বয়সেই একজন আঞ্চলিক কিংবদন্তিতে পরিণত হন। সে সময়ের সেই অখ্যাত বালক তার শ্রোতাদের নিজের মতো করে শোনাতেন নিজের শোনা যেকোনো রক গিটারিস্টের বাজনা; তাকে ড্রামার হিসেবে সঙ্গ দিতেন নিজেরই ভাই– যিনি তাকে সবসময়ই এভাবে সঙ্গ দিয়েছেন।
১৯৭২ সালে জেনেসিস-এর নাম বদলে ম্যামথ হয়ে ওঠে; কেননা, ততদিনে তারা জানতে পেরেছিলেন, তাদের ব্যান্ডের পুরনো নামটি একটি নির্দিষ্ট ব্রিটিশ প্রগ-অ্যাক্ট থেকে নেওয়া। পাসাডেনা তল্লাটে ম্যামথ ছিল সবচেয়ে রাউডি ও সবচেয়ে প্রতিভাধর ব্যান্ড; ব্যাক-ইয়ার্ক পার্টি সিনে পুলিশ প্রহরায় পারফর্ম করত তারা, যেখানে হাজারও রৌদ্রদগ্ধ শিশু জড়ো হতো যেকোনো বাড়ির পুলের কাছে– যাদের অবকাশে যাওয়া বাবা-মা এই কিশোরদের জিম্মায় সন্তানদের রেখে যাওয়ার মতো যথেষ্ট বোকামি করেছিলেন!
ডেভিড রথ নামে একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষি, ধৃষ্ট, ক্যারিশমাটিক, গলাবাজ স্থানীয় শিশু এই ব্যান্ডের কাছে গিয়ে সোজাসাপ্টা নিজেকে নতুন ফ্রন্টম্যান হিসেবে দলে বেড়ানোর প্রস্তাব দেন। তারা বিবেচনাও করেছিলেন সেই প্রস্তাব; কিন্তু দেখলেন, ওই ছেলে আসলে গান গাইতেই জানেন না। এর জেরে, হাল ছাড়তে নারাজ রথ নিজেই একটি প্রতিদ্বন্দ্বী পার্টি ব্যান্ড গড়ে তোলেন, এবং নিজের ভোকাল নিয়ে কঠোর সাধনা করতে থাকেন। পরিণামে এক সময় ম্যামথ-এ জায়গা করে নেন তিনি; এর অংশত কারণ, তাকে তার বাবা– ভীষণ সফল চক্ষু সার্জনের কিনে দেওয়া পিএ সিস্টেম ওই ব্যান্ড ইতোমধ্যেই ভাড়া করে ব্যবহার করছিল। এরপর থেকে রথের বাসার প্রশস্ত বেজমেন্টে প্র্যাকটিস শুরু করে ব্যান্ডটি।
হলিউড ক্লাবগুলোর দিকে নজর রাখছিলেন রথ। সেগুলো তো বটেই, আরও বহুদূরে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি ছিল তার। তিনি ব্যান্ডটিকে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট, পপধর্মী ও নৃত্যযোগ্য রাজত্বের দিকে ঠেলতে থাকেন, এমনকি তাদেরকে দিয়ে কে.সি. অ্যান্ড দ্য সানশাইন ব্যান্ড, জেমস ব্রাউন ও আইজলি ব্রাদারস কাভার করান (যদিও তাদের কাভার করা আইজলি ব্রাদারস-এর ইট’স ইউর থিং শুনতে অনেকটাই ব্ল্যাক সাবাথ-এর মতো লাগে)।
…
এডির কাছে বরাবরই যেকোনো
ফ্রন্টম্যান মাত্রই স্রেফ একটি
‘কণ্ঠস্বর’ ছাড়া বেশি
কিছু ছিল
না
…
মিউজিকের প্রশ্নে ভ্যান হ্যালেন দুই ভাই ছিলেন বিশুদ্ধতাবাদী; রাস্তার পোশাক পরেই মঞ্চে পা বাড়াতেন তারা; অ্যালবাম সাইডের নোট-পারফেক্ট কাভারের মাধ্যমে সবাইকে মাত করে দেওয়া ছিল তাদের লক্ষ্য। এডির কাছে বরাবরই যেকোনো ফ্রন্টম্যান মাত্রই স্রেফ একটি ‘কণ্ঠস্বর’ ছাড়া বেশি কিছু ছিল না; সেই কণ্ঠের ভেতর ‘শয়তান হয়ে ওঠা’র ছাপ চাইতেন তিনি।

রথ প্রসঙ্গে এডি একবার বলেছিলেন, তিনি ‘অপেরা সিংগার’ ছিলেন না। তবু তারই শোম্যানশিপ ও সেক্স অ্যাপিল, এবং পপ ও আর-অ্যান্ড-বি’র প্রতি তার ভালোবাসা এই ব্যান্ডকে ব্যাকইয়ার্ড থেকে বাইরে নিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত ব্যান্ডের নাম ভ্যান হ্যালেন রাখার আইডিয়াটিও কিন্তু রথেরই।
১৯৭৪ সালে ব্যান্ডটি একজন নতুন বেজিস্ট নিয়োগ দেয়– মাইকেল অ্যান্থনি। রসবোধে ভরপুর এই মানুষটির বাজানোর স্টাইলে নিজ বলিষ্ঠ শারীরিক গঠনের ছাপ পড়ত। আরেকটি জনপ্রিয় পার্টি ব্যান্ডের লিড সিংগার ছিলেন তিনি; এডির হারমোনির সঙ্গে তার পাওয়ারহাউস ব্যাকগ্রাউন্ড ভোকাল ভ্যান হ্যালেনকে একটি নতুন সিগনেচার সাউন্ড সৃষ্টি করতে সাহায্য করে, এবং এমন এক রৌদ্রোজ্জ্বল পপের আভাস দেয়– যা সেই যুগের হার্ড-রক কিংবা মেটাল অ্যাক্টের অন্যরা বলতে গেলে করার চেষ্টাও করেনি।
ব্রায়ান হাইয়েট: মিউজিক বিষয়ক লেখক; যুক্তরাষ্ট্র
সূত্র: রোলিং স্টোন; মাসিক ম্যাগাজিন, যুক্তরাষ্ট্র। ২৮ অক্টোবর ২০২০
পরের কিস্তি, আসছে…