আইয়ুব বাচ্চুর পাশ্চাত্য সংগীত প্রীতি

0
288
আইয়ুব বাচ্চু

লিখেছেন । হক ফারুক আহমেদ

আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের সংগীতে এক মহাপ্লাবনের নাম। যাতে ভেসে ভেসে দেশের কয়েক প্রজন্ম শিখেছে আধুনিক ব্যান্ড সংগীত কী, তার মান কেমন হওয়া উচিত। তাঁর মৃত্যুর পর এদেশের সংগীত সমাজের কাছে এ বিষয়টি আরও জোরালোভাবে ধরা দিয়েছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা হতে পারে। কিন্তু কোনো গুরুগম্ভীর আলোচনায় যেতে চাই না! সেটা আর আজকাল কেউ খুব একটা পছন্দও করে না। তবে মনে রাখতে হবে একসময় এ ধরনের আলোচনার গুরুত্ব যেমন ছিল, পাঠকও ছিল।

সবার কাছে যিনি আইয়ুব বাচ্চু, তিনি আমার কাছে বাচ্চু ভাই। প্রিয় বাচ্চু ভাই। আজ তার জন্মদিন, জন্মদিনের শুভেচ্ছা বাচ্চু ভাই। যেখানেই থাকুন আনন্দে থাকুন, গিটার নিয়ে থাকুন।

যে কথাটি বলছিলাম, আইয়ুব বাচ্চুর মানসম্পন্ন অনেক সৃষ্টির পেছনে একটি শক্ত ভিত লুকিয়ে ছিল। আর সেটা হচ্ছে তার পাশ্চাত্য সংগীতের প্রীতি ও সব ধরনের সংগীত ভেতরে ধারণ করার ক্ষমতা। মনগড়া কথা নয়, নিজস্ব স্মৃতিকথা ও বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে সংগীত ভাবনা বিনিময়ের সময় থেকেই তুলে ধরছি।

আইয়ুব বাচ্চু
আইয়ুব বাচ্চু [১৬ আগস্ট ১৯৬২–১৮ অক্টোবর ২০১৮]

২০০০ থেকে ২০১৩ পর্যন্তও নিয়মিত যাতায়াত ছিল মগবাজারের কাজী অফিসের গলির ‘এবি কিচেনে’। আমি আর আমার বন্ধু মাহমুদ মানজুরের অফিস ফেরত সন্ধ্যাগুলো সেখানেই আড্ডার ঝড়ে মেতে থাকত। কোনো কোনো দিন মানজুরকে না পাওয়া গেলে একাই ছুটতাম এবি কিচেনে। আড্ডার বিষয় ছিল গান, অডিও ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে চটুল টিপ্পনী!

এবি কিচেনের একপাশে এলআরবি‘র অনুশীলন ঘর, পেছনের দিকে রেকর্ডিং স্টুডিও আর মাঝখানটায় সবার বসার জায়গা। সেখানে একপাশে দুটো টেবিল আর লম্বা একটা সোফা। এখানেই রং চা খেতে খেতে আমাদের সেই সময়ের সন্ধ্যাগুলো রঙিন হয়ে উঠত। আড্ডায় বাচ্চু ভাই ছাড়া এলআরবি বেজিস্ট স্বপন ভাই, ড্রামার রিয়াদ ভাই ও বাচ্চু ভাইয়ের চট্টগ্রামের অনেক ভাই, বন্ধুরা থাকতেন।

পাশ্চাত্য রক ও হেভি মিউজিক বরাবরই আমার আগ্রহের জায়গা। একদিন এবি কিচেনের কাঁচের টেবিলের নিচে দেখি ইংল্যান্ডের ‘নিউ ওয়েভ অব ব্রিটিশ হেভি মেটাল’ যুগের পাইওনিয়ার ব্যান্ড স্যাক্সন-এর একটা ছবি। বাচ্চু ভাই আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাচ্চু ভাই, আপনি কি স্যাক্সন-এর গান শুনেন? বাংলাদেশে কিন্তু খুব একটা শ্রোতা-ভক্ত নেই ওদের।’

আইয়ুব বাচ্চু

বাচ্চু ভাই গল্প জুড়ে দিলেন। দেশের বাইরে এলআরবির কোনো একটা ট্যুরে যাওয়ার সময় ইংল্যান্ডের এক বিমানবন্দরে স্যাক্সন ব্যান্ডের সঙ্গে বাচ্চু ভাইয়ের দেখা হয়। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে সেদিন স্যাক্সন ব্যান্ডের গায়ক বিফ বাইফোর্ডের আলাপ হয়েছিল। বাচ্চু ভাই এটাও বলেছিলেন, তিনি প্রথম স্যাক্সনদের চিনতে পারেননি। বিফকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমাদের ব্যান্ডের নাম কী?’ আর বিফ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘পিপল কল আস স্যাক্সন।’

আইয়ুব বাচ্চু ঘুমন্ত শহর গানটিতে বাজানো একটি গিটার অংশ ভ্যান হ্যালেন-এর ক্যান্ট স্টপ লাভিং ইউ গানটি থেকে অনুপ্রাণিত বলেই সবাই জানে। কিন্তু আদতে গিটারের সেই অংশটি ব্যান্ড স্যাক্সন-এর আই ক্যান্ট ওয়েট এনিমোর গানটি থেকে অনুপ্রাণিত। এই গানটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স্যাক্সনদের ডেসটিনি অ্যালবামের একটি ব্যালেড রক গান।

ঢাকায় তখন কেবল ডিভিডি আসতে শুরু করেছে। তার কয়েক বছর আগেই ‘জি থ্রি: লাইভ ইন কনসার্ট’ ভিডিও সিডিতে দেখে অনেকেরই মাথা নষ্ট! জো স্যাট্রিয়ানি, স্টিভ ভাই, এরিক জনসনের গিটার বাজানো লাইভে দেখার অভিজ্ঞতা অনেকেই সেটা প্রথম। এই মাথা খারাপ হওয়াদের দলে আইয়ুব বাচ্চুও ছিলেন। এলিফেন্ট রোড আর রাইফেলস স্কয়ারের কয়েকটি দোকানে এই কনসার্ট আর জো স্যাট্রিয়ানির কনসার্টের লাইভ ডিভিডি পাওয়া গেল। আইয়ুব বাচ্চু সবগুলোই সংগ্রহ করলেন।

এবি কিচেনে প্রায় গেলে দেখি, বাচ্চু ভাই জো স্যাট্রিয়ানির লাইভ দেখছেন। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাচ্চু ভাই, এতবার দেখছেন যে?’ তিনি আমাকে উত্তর দিলেন, ‘শোন, যখন কিছু ভালো লাগে না, মাথা থেকে কিছু আসে না, তখনই জো স্যাট্রিয়ানি দেখি। উফফ…! এভাবেও কি গিটার বাজানো সম্ভব, এত আবেগ!’

আইয়ুব বাচ্চু

আমি বললাম, ‘বস, আপনি মার্টি ফ্রিডম্যানও শুনতে পারেন। গিটারে আবেগ ঝারতে তার মতো পারদর্শী আর কেউ নেই। মার্টি অদ্বিতীয়।’

আমার দিকে পচা মুখ করে বাচ্চু ভাই বললেন, ‘মার্টি ফ্রিডম্যান আমার ভালো লাগে না।’

আমি বললাম, ‘বাচ্চু ভাই, আপনি আর কমল ভাই (ওয়ারফেজ-এর গিটারিস্ট ইব্রাহিম আহমেদ কমল) মিলে জি থ্রি’র মতো একটা প্রজেক্ট করতে পারেন।’

এবার বাচ্চু ভাই বললেন, ‘এটা তো ভালো বলছিস। আমি রাজি। আমার হয়ে কমলকে তুই বল।’ আফসোস, এই আলোচনার সমাপ্তি সেখানেই হয়। বিষয়টা কখনোই আর কমল ভাইকে জানানো হয়নি।


‘দেখ, দেখ, বাচ্চু ভাই পুরাই
জো স্যাট্রিয়ানিকে
ফলো করতেছে’

বাচ্চু ভাই ‘৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত জো স্যাট্রিয়ানিকে নিয়ে মেতে ছিলেন। সেই মাতামাতি এতটাই প্রবল ছিল যে, তার গিটার বাজানো থেকে ফ্যাশনেও জো স্যাট্রিয়ানির প্রভাব লক্ষ্য করা গেল। তিনি জো স্যাট্রিয়ানির মতো মাথা ন্যাড়া করে ফেললেন, প্রায় একই ধরনের সানগ্লাস আর টি-শার্ট পরে স্টেজে উঠতে লাগলেন। সাংবাদিক মহলেও যারা জো স্যাট্রিয়ানিকে চিনেন, তাদের মধ্যে কানাঘুঁষা হচ্ছে, ‘দেখ, দেখ, বাচ্চু ভাই পুরাই জো স্যাট্রিয়ানিকে ফলো করতেছে।’

কিন্তু বাচ্চু ভাইকে যখন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করি, তখনই বলেন, ‘এসব তোরা কী বলিস! এটা আমার স্টাইল।’

পরবর্তী সময়ে বাচ্চু ভাই রেড হট চিলি পিপারস-এর ক্যালিফোরনিকেশন গানটা প্রায় সব কনসার্টই করতেন। হার্ডরক মিউজিক থেকে তিনি একটু দূরে সরে যাচ্ছিলেন। পাঙ্ক, ফাঙ্ক, মাঝে মধ্যে হিপহপ মিউজিকেও অনুরক্ত হয়ে ওঠেন। তার হেভি মিউজিকের লেভেল তখন রেজ অ্যাগেইনস্ট দ্য মেশিন-এর বেশি উঠে না। ভালোবাসেন ডিডোও। বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতাম না। খেয়াল করলে দেখবেন, সেই সময়ের মনে আছে নাকি নাই, স্পর্শ অ্যালবামের মিউজিক এলআরবির আগের অ্যালবামগুলোর মিউজিকের তুলনায় অপেক্ষাকৃত হালকা মেজাজের। গানের কথার গভীরত্বও কম।


সেই সময় একজন আগাছা সাংবাদিক
বাচ্চু ভাইয়ের আশেপাশে
থাকতেন আর
অপেক্ষাকৃত
লঘু
সংগীতে তাকে অনুপ্রাণিত করতেন

আমি এ দোষ পুরোপুরি বাচ্চু ভাইকে দেই না। সেই সময় একজন আগাছা সাংবাদিক বাচ্চু ভাইয়ের আশেপাশে থাকতেন আর অপেক্ষাকৃত লঘু সংগীতে তাকে অনুপ্রাণিত করতেন। এটা কিছুটা তার ফসলও মনে করি। তাছাড়া, সেই সময় তিনি যাদেরকে দিয়ে গান লিখিয়েছেন, তারাও খুব ভালো কিছু উপহার দিতে পারেননি তাকে। ব্যক্তিগত এই মতামতে আমার অবস্থান স্পষ্ট।

২০০৬-২০০৭-এর দিকের কথা। ততদিনে দেশের ব্যান্ড সংগীতে জোরালো অবস্থান নিয়েছে ক্রিপটিক ফেইট, আর্টসেল, মেটাল মেইজ, ব্ল্যাক-এর মতো ব্যান্ড। বাচ্চু ভাইকে তার এক জন্মদিনে আমি সিম্ফনি এক্স-এর অডিসি আর এভান্টাসিয়ামেটাল অপেরা পার্ট ওয়ান অ্যালবামটি উপহার দেই। তার কয়েকদিন পর আবার এবি কিচেনে গেলাম। বাচ্চু ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাচ্চু ভাই, কেমন লাগল অ্যালবাম দুইটা?’

এভান্টাসিয়া নিয়ে তিনি কিছু বললেন না। কিন্তু সিম্ফনি এক্স নিয়ে তার মন্তব্য আমাকে ব্যথিত করল। বললেন, ‘যা! এটা কিছু হইলো! একেকটা একেক দিকে ছুটে!’

আমি প্রশ্ন করলাম, মাইকেল রোমিওর গিটারও ভালো লাগেনি? তিনি বললেন, ‘না।’ আমি বুঝলাম, বাচ্চু ভাই এখনো ফাঙ্ক ধুনে পড়ে আছেন।

এরপর এবি কিচেনে স্বাভাবিক যাতায়াত করি; কিন্তু মিউজিক বিষয়ে কথা হয় কম। ২০০৮-এর দিকের কথা। হঠাৎ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে দেখি বাচ্চু ভাই সিম্ফনি এক্স‘র গিটারিস্ট মাইকেল রোমিওর ভূয়সী প্রশংসা করছেন। আরেকদিন লাইভে দেখলাম জিমি হেনড্রিক্স’র ফক্সি লেডি আর ডিপ পার্পল-এর স্মোক অন দ্য ওয়াটার গাইছেন। মনে মনে আমি বললাম, লাইনে আসছেন তাইলে!

কয়েকদিন পর এবি কিচেনে গেলাম। আমাকে দেখেই বললেন, “শোন ফারুক, এলআরবি তার রুটে ফিরে যাবে। হার্ডরক আর হেভি মিউজিকে ফিরে যাবে। তবুওর চেয়েও হেভি মিউজিকের অ্যালবাম করবে।”

এলআরবি‘র কোনো এক কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চু

আমি বললাম, ‘সেটাই তো আপনার আসল জায়গা। টিভিতে দেখলাম মাইকেল রোমিওর প্রশংসা করতেছেন।’

বাচ্চু ভাই এবার শুধু হাসলেন।

এলআরবির পরবর্তী অ্যালবাম যুদ্ধ তার আগের কয়েকটি অ্যালবামের চাইতে অনেক বেশি পরিপক্ক ও হেভি মিউজিকের অ্যালবাম। যাকে আমি বলি, এলআরবির শেকড়ে ফিরে যাবার চেষ্টার প্রথম প্রয়াস।

আসলে বাচ্চু ভাই ছিলেন জাত শিল্পী। আর জাত শিল্পীর একটি অন্যতম গুণ হচ্ছে নানা দেশ, নানা সংস্কৃতির সংগীত শোনা, তাকে জানা। নিজের মধ্যে সব ধরনের সংগীত ধারণ করা এবং তা থেকে নিয়ে নিজের মতো করে উপস্থাপন করা। কাজটি সহজ নয়।


নিজস্ব ও বৈশ্বিক সংগীতকে
নিজের মধ্যে ধারণ
করেই তিনি
নিজেকে
সমৃদ্ধ করেছিলেন

বাচ্চু ভাই সব ধরনের সংগীতকে ভালোবাসতেন। সেটা পাশ্চাত্যের হেভি মেটালই হোক আর বাংলার আব্দুল আলীমই হোক। সেখানে নয়ন মুন্সি যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন জন পেট্রুচি। নিজস্ব ও বৈশ্বিক সংগীতকে নিজের মধ্যে ধারণ করেই তিনি নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তারপর বাংলা ব্যান্ডের গানে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করে তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রজন্মের পর প্রজন্মে। অনবদ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি যুগপৎ তৈরি করেছেন। নিজেই সৃষ্টি করেছেন নতুন ইতিহাস।

Print Friendly, PDF & Email
গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক; ঢাকা, বাংলাদেশ ।। গল্পগ্রন্থ: জলের জমিন; শহরে দেবশিশু ।। কবিতার বই: নিঃসঙ্গতার পাখিরা; মেঘদরিয়ার মাঝি ।। প্রবন্ধ সংকলন: ধীমান কথন ।। সম্মাননা: সিটি ব্যাংক আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯